top of page
আবার অন্তর্ধান

আবার অন্তর্ধান

শব্দ-জব্দ

রাজা মুখার্জি

আজ উইকলি অফ ডে। আজ ফুলটু ল্যাদ খাওয়ার দিন। তবে চিফ রিপোর্টার হিসেবে প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে ল্যাদ খুব একটা হয় না। সারাক্ষণ-ই ফোন বাজতে থাকে। মা ভীষণ বিরক্ত হন। তাঁর মতে এর থেকে আমি অফিসে থাকলেই শান্তি। আগে হা-পিত্যেশ করতেন আমার বিয়ে টিকবে না ভেবে। তারপর স্যান্ডির আর আমার ব্যাপারটা জেনে অবধি সে চিন্তা কমেছে। তাঁর সখেদ উক্তি “যেমন দ্যাবা তেমনি দেবি, একেবারে রাজযোটক।” 

সত্যি, মায়ের কথাটাও ফ্যালনা নয়। সাংবাদিকতা, বিশেষত টেলিভিশন মিডিয়ায় নিজের জন্য কোনো সময় নেই। দায়িত্বে থাকলে তো আরও নয়। সিনেমা হলেও অ্যাসাইনমেন্ট ডেস্ক বা রিপোর্টারদের ফোন ধরতে হয়। আশপাশের দর্শক বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। উঠে বেরিয়ে যেতে হয়। তবে সাম্প্রতিক-কালে মা-এর কপালের ভাঁজ স্যান্ডি অর্থাত্‌ তাঁর হবু বৌমা-কে নিয়ে। চিফ অ্যাঙ্কর আর সিনিয়র রিপোর্টার ব্যাপারটা মেনে নিলেও ওর গোয়েন্দাগিরিটা হজম করতে পারছেন না। না, না কোনো ট্যাবু নেই। বৌমা-র নিরাপত্তাজনিত চিন্তা আর কি! স্যান্ডির বাবা-মা তো সাক্ষর বুঝবে বলে আমার কোর্টে-ই বল ঠেলেছেন। তবে আমি জানি আমার সাপোর্টটাই স্যান্ডির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

হঠাত্‌ কলিং বেল বেজে ওঠে। এখন আবার কে!

বোঝো! শয়তান কা নাম লিয়া শয়তান হাজির। স্যান্ডির উত্তেজিত গলা শুনতে পাচ্ছি। দোহাই পাঠককূল এই শয়তান সংক্রান্ত মন্তব্যটা যেন স্যান্ডির কানে তুলবেন না। জঙ্গী মেয়ে, তায় ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট।

- কিরে ল্যাদ খাচ্ছিস তো?

সোজা আমার ঘরে। অনুমতি-টতির বালাই নেই। একবার বলতে গিয়ে ঝাড় আর জ্ঞানের বন্যায় সুনামিগ্রস্থ হয়েছিলাম। অর্থাত্‌ নিজের ঘরের অধিকারটা আগেভাগেই নিয়ে নিয়েছে। অগত্যা!

- আমার তো অফ ডে। তোর তো আজ মর্নিং শিফ্ট! তুই অফিস ছেড়ে এখানে কেন?

- দাঁড়া বাবা বসতে দে। একেবারে ক্যাডাভ্যারাস সিচ্যুয়েশন।

সোফায় নিজের দেহটাকে ছেড়ে দেয় স্যান্ডি। ব্লু জিনস আর মেরুন টপ। হেব্বি সেক্সি লাগছে। বললেই ক্যালাবে।

- সাক্ষরদা আসছি?

আমাকে অবাক করে দিয়ে কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘরে ঢোকে আমাদের চ্যানেল ফাইভের সিনিয়র ক্যামেরাপার্সন সোমেন।

- যাঃ বাবা, ব্যাপারটা কী বলবি তো তোরা?

- কাল তুই অফিস থেকে বের হওয়ার আগে যে ব্রেকিংটা কন্টিনিউ করতে বলে এলি মনে আছে? তুই নাকি বলেছিলিস এটার ইন্টারেস্টিং ফিচার আছে।

- হ্যাঁ, কেন মনে থাকবে না! কলকাতার বিখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সন্দীপ দে-র রহস্যজনক অন্তর্ধান। তাও আবার পুরুলিয়ার বরোন্তিতে। সপরিবারে বেড়াতে গিয়ে। জব্বর খবর। একটু আগে চ্যানেলে দেখলাম। চলছে তো! আজ ভোরে টিম পাঠাতেও বলেছিলাম।

আমি বেশ অবাকই হই। মর্নিং শিফ্টে বিক্রমের থাকার কথা। ওকে আর ক্যামেরায় রাজর্ষিকে পাঠাতে বলেছিলাম। স্যান্ডি রহস্যের ব্যাখ্যা দেয়।

- তাই ঠিক ছিল। চিফ এডিটর বিশ্বজিতদা অ্যাসাইনমেন্টে ফোন করে ওদের যেতে বারণ করেন। তারপর আমায় ফোন। বললেন আমি যেন সোমেনকে নিয়ে যাই আর যাওয়ার পথে তোকে তুলে নিই। তোকে ফোন করেননি?

স্যান্ডি শেষ করতে না করতেই আমার ফোন বেজে ওঠে। বিশ্বজিতদা।

- কী ব্যাপার কী, সাক্ষর? বাড়িতে কি ফোন মাটি চাপা দিয়ে রাখো? খালি বলে নট রিচেবল!

- আসলে বিশ্বজিতদা, পুরনো বাড়ি তো, ২০ ইঞ্চির দেওয়াল, তাই বোধহয়…

- যাকগে যাক। স্যান্ডি পৌঁছেছে?

- জাস্ট এলো। কিন্তু ব্যাপারটা কী এখনও জানিনা!

- শোনো তোমার উইকলি অফ ক্যান্সেল। পরে দিয়ে দেব। তুমি এখনি রেডি হয়ে স্যান্ডিদের সঙ্গে বরোন্তি রওনা দাও।

- স্যান্ডি সিনিয়র রিপোর্টার। ও যাচ্ছে। তারপরেও আমি..!

- জানি, জানি। ওটা আমি বুঝব। আমি আমার বেস্ট দুজনকে পাঠাচ্ছি। তোমার রিডিং-টা ঠিক, এটা বড় খবর হবে। স্যান্ডি যাবে গোয়েন্দা কাম অ্যাঙ্কর হিসেবে। তুমি যাবে চ্যানেলের বেস্ট রিপোর্টার, তাই। বাকিরা জেলার ছেলেদের দিয়েই কভার করাচ্ছে। কিন্তু আমরা আর একটা রাঘবেন্দ্র মিত্র অন্তর্ধান রহস্য উদ্ঘাটন করতে চাই (গল্প- ফিসফাস)। বস, টি আর পি-টা ভাবতে হবে তো। তাছাড়া তুমি না গেলে পরে গল্পটা কে লিখবে!

একটা বিচ্ছিরি রকম ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলেন বিশ্বজিতদা।

অগত্যা!

 

চলো বরোন্তি

 

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরেছে আমাদের গাড়ি। আসানসোল হয়ে সেখান থেকে বাঁদিক নেব। তারপর গড় পঞ্চকোট বা পাঞ্চেত পাহাড়কে ডাইনে রেখে আমাদের ঢুকতে হবে বাঁদিকে বরোন্তি যাওয়ার জন্য।

- কাল যখন খবরটা হয় আই ওয়াজ আউট অফ অফিস। আজও খবর দেখা হয়নি। আমাকে একটু ব্রিফ করবি সাক্ষর, প্লিজ?

গাড়ির মাঝের সিট-এর ডানদিকে জানলার ধারে বসে স্যান্ডি। বাঁদিকে সোমেন। আমি সামনে। আলগোছে ঘুরে বসি ওর দিকে।

- আমাদের পুরুলিয়ার স্ট্রিঙ্গার প্রথম খবরটা দেয় সন্ধ্যে নাগাদ। তার আগেরদিন মানে পরশু রাত থেকে ডাঃ দে মিসিং। যদিও সকালের আগে ওঁর সঙ্গের লোকেরা রি-অ্যাক্ট করেননি। সকালে বারে বারে ফোনে না পেয়ে এবং কলকাতা-তেও ফেরেননি জেনে স্থানীয় থানায় মিসিং ডায়রি করান। পরশু বিকেলে বরোন্তি ড্যাম ধরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন ডাঃ দে। একাই। তারপর আর কেউ তাঁকে দেখেননি।

- কে কে বেড়াতে গেছিল জানিস?

- সস্ত্রীক ডাঃ দে এবং তাঁর আরও তিন বিজনেস পার্টনার। সকলেই স্ত্রীদের নিয়ে। এরমধ্যে আরও চার জন চিকিত্‌সক আছেন। কলকাতার বিখ্যাত চাইল্ড এন্ড মেটারনিটি কেয়ার নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত সকলেই। তারমধ্যে ডাঃ সন্দীপ দে আবার শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। তাই হইচই-টা ভালই হবে। আমার ধারণা সেই জন্যই বিশ্বজিতদা চান্স নিতে চায়নি।

- রাইট ইউ আর।

গম্ভীর হয়ে যায় স্যান্ডি। বুঝতে পারি ওর মাথায় এখন নানান প্রশ্ন ঘুরছে। বরোন্তি না পৌঁছলে যার একটারও উত্তর পাওয়া যাবে না। সোমেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আসলে এই মুহুর্তে ওর করারও কিছু নেই।

হঠাত্‌ সেল ফোনটা বেজে ওঠে। সুবীর। আমাদের পুরুলিয়ার স্ট্রিঙ্গার।

- হ্যাঁ, সুবীর বল।

- দাদা, তোমরা রওনা দিয়েছো?

- হ্যাঁ, শক্তিগড় ক্রশ করছি। ওদিকে কোনো ডেভেলপমেন্ট?

- সেটা জানাতেই ফোন করলাম। ডাঃ সন্দীপ দে-র ডেডবডি পাওয়া গেছে।

- হোয়াট? অ্যাসাইনমেন্টে খবর দিয়েছিস?

- হ্যাঁ, ওরাই জানাল তোমরা আসছো। আর সমস্ত আপডেট দিতে বলল।

- কোথায় পাওয়া গ্যাছে ডেডবডি?

- পাঞ্চেত পাহাড়ের নিচে জংলা জলাজমির পাশে। স্থানীয় এক গ্রামবাসী কাঠকুটো আনতে জঙ্গলে ঢুকেছিল, সেই দেখেছে।

- কী ভাবে মারা গেল?

- পুলিশ বলছে পাহাড় থেকে পড়ে। তবে মাথায় অন্য রকম চোট আছে বলেও সন্দেহ করছে। খোদ এসপি সাহেব তদন্তে রয়েছেন।

- যেখান থেকে পড়েছে বলে ডাউট করছে, ইজ দ্যাট প্লেস ইজি অ্যাক্সেসেবল? জিগ্যেশ করতো সুবীরকে।

প্রথম থেকেই স্পিকার অন করা ছিল। যাতে স্যান্ডি পুরো কথোপকথনটা শুনতে পায়। আমাকে জিগ্যেশ করতে হয়না। সুবীর শুনতে পেয়েছে।

- হ্যাঁ, স্যান্ডিদি। ওখানে গাড়ি নিয়ে ওঠা যায়। তবে কাঁচা রাস্তা। বড় চাকার গাড়ি ছাড়া হবে না।

- সুবীর, পাহাড়ের ওই জায়গার হাইট কতটা হতে পারে?

- বারো-চোদ্দ’শ ফিট হবে।

- ওকে, তুই পুলিশের সঙ্গে লেগে থাক। পারলে ডাঃ দে-র সঙ্গীদের রি-অ্যাকশন পাঠা অফিসে।

- পাঠিয়েছি সাক্ষরদা। ওরা কিছুই বুঝতে পারছেন না।

 

না, ব্যাপারটা আর রাঘবেন্দ্র মিত্র অন্তর্ধান রহস্য থাকল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে উনি কেন গিয়েছিলেন ওখানে? আত্মহত্যা! স্যান্ডি বোধহয় আমার ভাবনার গতিপ্রকৃতি আঁচ করেছে।

- হোমিসাইড হওয়ার প্রব্যাবিলিটি মোর দ্যান নাইনটি নাইন পার্সেন্ট।

- তুই কী করে এখান থেকেই এত শ্যিওর হচ্ছিস?

- সি, ডাঃ দে অ্যারাউন্ড সিক্সটি ইয়ারস। রাইট? খামোখা বরোন্তি থেকে গড় পঞ্চকোট অতটা রাস্তা হাঁটবেন কেন? তাছাড়া শুনেছি বরোন্তির আশপাশে আরও পাহাড় আছে। দোজ আর মাচ নিয়ারার। এখন উনি যদি গাড়ি নিয়েই যাবেন তাহলে গাড়ির কথা কেউ বলছে না কেন? কারণ ওখানে গাড়ি নেই। অর্থাত্‌ কেউ একজন ছিল। যে গাড়ি নিয়ে ফিরেছে। তার মানে সেই মার্ডারার।

- কে সে?

- ইডিয়টের মতন কথা বলিস না সোমেন। এখান থেকে কেমন করে বলব!

প্রশ্ন করে খামোখা ঝাড় খেয়ে চুপ করে যায় সোমেন। আমি জানি স্যান্ডির অনুমান নির্ভুল। খুবই যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা।

 

পাঞ্চেত মোড় পার হলাম তখন প্রায় তিনটে বেজে গিয়েছে। স্যান্ডি আগেই বলে দিয়েছিল ও পাঞ্চেত পাহাড়ে আগে উঠতে চায়। যেখান থেকে ডাঃ দে পড়েছেন বা তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। একটা পিটুসি-ও (পিস টু ক্যামেরা) করবে। কারণ পৌঁছে একটা ফিড তো পাঠাতে হবে চ্যানেলের জন্য। বাবলু, আমাদের যানচালক নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে লোকজনকে জিগ্যেশ করে রাস্তা খুঁজে বের করার।

- সাক্ষর, গড় পঞ্চকোট সম্পর্কে কিছু জানিস? আসলে রিসার্চ করার সময় পেলাম না। জায়গাটা এস্টাব্লিশ করতে গেলে একটু ইতিহাস ভূগোল বলতে হবে তো! না হলে মার্ডার কেস ঠিক জমবে না।

যতটা জানা আছে গাড়িতেই ব্রিফ দিলাম স্যান্ডিকে।

- পূর্বভারতের প্রাচীনতম রাজত্ব গড় পঞ্চকোট। প্রায় নব্বই খ্রীস্টাব্দে দামোদর শেখ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন জনজাতি বা খুঁট-দের নিয়ে এই রাজত্ব স্থাপন করেন। পাঁচ খুঁট থেকেই পঞ্চখুঁট বা পঞ্চকোট। পুরাণে শেখরভূমি বা শেখরভূম নামে এ অঞ্চলের উল্লেখ আছে। তারপরই দামোদর শেখের রাজচাকলা রাজবংশের দুর্গ তৈরি হয় এই পাহাড়ে। দুর্গ থেকে গড়। তাই গড় পঞ্চকোট। পরে এই রাজবংশের নাম হয় সিংদেও রাজবংশ। সেও মোটামুটি মধ্যযুগে এসে। একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দিই। তোর কাজে লাগবে। এই পাহাড়ের বিস্তৃতি প্রায় ১৮ কিলোমিটার আর সর্বোচ্চ পয়েন্ট ২,১০০ ফিট। শোনা যায় রাজ আমলে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের পাহাড়ের এরকমই কোনো এক উঁচু জায়গা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হত হত্যা করার জন্য। যে কারণে এ পাহাড়কে ঘাতক পাহাড় বা এক্সিকিউশন হিল-ও বলা হয়।

- ফাটিয়ে দিয়েছিস সাক্ষর। এক্সিকিউশন হিল থেকে ডাঃ সন্দীপ দে’র এক্সিকিউশন! জাস্ট জমে যাবে।

 

কুশীলব-রা

 

প্রয়োজনীয় শ্যুটিং সেরে ফিড পাঠিয়ে থানায় গেলাম। বলা হয়নি আমাদের পিছন পিছন ডিএসএনজি ভ্যানও (ডাইরেক্ট স্যাটেলাইট নিউজ গ্যাদারিং যাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল করে ওবি ভ্যান বলা হয়) পাঠিয়েছেন বিশ্বজিতদা। যাতে সময় সময় লাইভ করা যায়। স্থানীয় থানা হাব-ভাবেই বুঝিয়ে দিল খুব একটা পাত্তা পাওয়া যাবে না। তাই সরাসরি এসপি সাহেবকেই ফোন করলাম। আগেই আলাপ ছিল। তাই পরিচয় দেওয়ার ঝক্কি ছিল না। তবে উনি যে স্যান্ডির সাম্প্রতিক গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল জেনে চমকে গেলাম। সবরকম সাহায্যের আশ্বাস মিলল। নেহাত স্যান্ডির টপ-এর কলার নেই, থাকলে ছেড়ে কথা বলত না। কারণ ও এটাকে আজকাল বেশ রেলিশ করে।

বরোন্তি ঢুকলাম অন্ধকারে। যে আকাশগঙ্গা রিসোর্টে ডাঃ দে-র টিম আছে সেখানেই দুটো রুম পাওয়া গেল। সকলের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় সেরে রুমে এলাম। আজ রাতের মতন কিছু করার নেই। খালি পরিচয় হয়নি মিসেস দে-র সঙ্গে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।  

- আপাতত যাঁদের সঙ্গে আলাপ হল তাঁদের কাকে কী বুঝলি?

ল্যাপটপে নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল স্যান্ডি।

- ডাঃ তাপস দত্ত। ইনি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। বয়স ৬০-৬৫। নার্সিংহোমে শুরু থেকেই আছেন। উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন বা চার। স্বাস্থ্য ভাল। মাঝারি রঙ। তবে সবথেকে গ্ল্যামারস তাঁর টাক খানা। চুরুটপানের বদভ্যাস আছে।

- আর?

- আর কী!

- মুদ্রাদোষটা বললি না?

- রাইট, কথায় কথায় ‘আই মিন’ বলার রোগ আছে।

- নেক্সট।

- ওনার ঘরণী। ইনিও চিকিত্‌সক। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। নাম সুমনা দত্ত। বয়স ৪০ এর বেশি নয়। খুব সম্ভবত দ্বিতীয় পক্ষ। উচ্চতা বরের সমান। ফিগারটি খাসা। মনে হয় নিয়মিত জিম করেন, তোর মতন। দেখতেও দিব্য। তবে মুখে একটা আপাত কাঠিন্য আছে। মিতভাষী।

- মিতভা sssii?

- ভাsssii না, ভাষী। মানে কম কথা বলেন আর কি।

বাংলায় স্যান্ডির চিরন্তন আটকা পড়ার অভ্যেস যাওয়ার নয়। তবে একটুও বিব্রত হয়ে না।

- লিভ ইট, বাট সো ফার গুড। তারপর, মাই ডিয়ার হবু হাবি?

স্যান্ডি-র মেজাজ বেশ খুশ। তাই একটু তোয়াজের সুর। শুনতে অবশ্য ভালই লাগে।

- মিস্টার মহেশ রাঘবন। তিনপুরুষ এ বঙ্গদেশেই বাস। তাই পুরোদস্তুর বাঙালি। ইনি নার্সিংহোমের আধিকারিক প্রধান বা অ্যাডমিন হেড বলতে পারিস। গায়ের রঙ বেশ কালো। কালো জামা পড়ে রাতে দাঁড়ালে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

- তোর ফুটনোট গুলো বাদ দিয়ে বল।

- উচ্চতা প্রায় ৬ ফিট। রোগা পাতলা চেহারা। এক মাথা কাঁচা পাকা চুল।

- সল্ট অ্যন্ড পিপার।

- হ্যাঁ, মুখে সবসময় হাসি ঝুলে আছে। যেন বিগলিত ভাব। বয়স ৪০ থেকে ৬০ এর মধ্যে যা খুশি হতে পারে।

- খুব সম্ভব ওভার সিক্সটি। ডাঃ দত্ত-র সঙ্গে নাম ধরে তুই-তোকারির সম্পর্ক। তারপর।

- ডাঃ শ্রীলা রাঘবন। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। মাঝারি উচ্চতা। খুব কমন ফেস। একটু মা মা ব্যাপার আছে। মিসেস দে-কে ইনিই সামলাচ্ছেন। বয়স ৫৫ থেকে ৬০ এর মধ্যেই।

- হুম

- ডাঃ সমর মল্লিক। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। ৬০-৬২। মাঝারি উচ্চতা।

- উঁহু মাঝারি বললে হবে না।

- পাঁচ পাঁচ বা পাঁচ ছয়।

- রাইট।

- দৃশ্যত এনাকেই সব থেকে শকড মনে হল। একটু বাঙালিয়ানা আছে।

- ধুতি পাঞ্জাবি পরে ছিলেন বলে বলছিস?

- সেটা একটা কারণ, তবে বাকি দুই ভদ্রলোক শেক হ্যান্ড করলেন। মিসেস-রাও একজন ছাড়া সকলেই হায়, হায় রব তুললেন। এনার মিসেসও। ইনি কিন্তু যুক্তকরে নমস্কার করলেন আলাপের সময়।

- গুড অবজার্ভেশন। এইজন্যই তুই ভাল রিপোর্টার। বলে যা।

- স্বপ্না মল্লিক। বললেন তো হাউজওয়াইফ।

- উঁহু, হাউজওয়াইফ বলেননি, বলেছেন হোমমেকার।

- ঐ একই হল।

- তা বললে চলবে কেন! বেশ বলে যা।

- আধুনিকতার চলমান বিজ্ঞাপন। পোষাক-আশাক আর প্রসাধনে দুর্ঘটনার কোনো ছাপ নেই। বয়স ৫০ এর ওপরে কিন্তু ৪০-এর নিচে নামানোর আপ্রাণ চেষ্টা। সম্ভবত কিটি পার্টি আর সোস্যাল ফাংশনেই দিন কাটে।

- ওয়েল, তাহলে একটা ছবি পাওয়া গেল, কি বল? এবার কাল সকালে একটু ক্রশ করেত হবে।

- কিন্তু ওরা তোকে মেনে নেবে কেন? যতক্ষণ অ্যাঙ্কর আছিস ঠিক আছে, গোয়েন্দা হতে চাইলেই প্রতিরোধ আসবে। আমার তো তাই ধারণা।

- ইউ আর রাইট। কায়দা করতে হবে। ইফ রিক্যুয়ার্ড এসপি সাহেবের হেল্প নিতে হবে। বাট প্রাইমারিলি দুটো কাজ, কথা বলে মোটিভ সম্পর্কে একটা আইডিয়া তৈরি করা আর পোস্টমর্টম রিপোর্ট-টা জানা। সেতো পরশুর আগে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

- কিন্তু জনগণদের কি পরশু অবধি আটকানো যাবে?। যা প্রভাবশালী লোকজন, পুলিশকে হয়তো পাত্তাই দেবে না। কালই না কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেয়। তাহলে তো আমাদের আসাটা পুরো মাটি।

- লিভ ইট ইয়ার, কাল সকাল হলে দেখা যাবে। খুব টায়ার্ড লাগছে আমি শুচ্ছি।

- তুই শো, আমি দেখে আসি সোমেন আর বাবলু ঠিক আছে কিনা। গুড নাইট।

 

তদন্ত

 

বাড়ির বাইরে এলেই কেন কে জানে আমার ঘুম ভেঙে যায় ভোরবেলায়। বরোন্তিতেও ব্যাতিক্রম হল না। এখন পৌনে পাঁচটা। সোমেন বলেছিল আগে উঠলে ওকেও ডাকতে। ভোরে ভাল ছবি হয়। তাছাড়া এলাকাটাও দেখিনি এখনও। স্যান্ডিকে ডাকলাম। তারপর মিনিট পনেরোর মধ্যে তিনজনে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

আকাশগঙ্গা রিসর্টটা বরোন্তি দীঘির এক প্রান্তে। সামনে পথ সোজা চলে গেছে দীঘির ধার বরাবর। তারপর তিনদিক বেড় দিয়ে বেরিয়ে গেছে মুরাডিহ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কাল অন্ধকার থাকায় কিছুই টের পাইনি। দীঘির চারপাশ ঘিরে অনেকগুলি টিলা। পরে জেনেছিলাম মোট বারোটা টিলা পাহাড় আছে। যার মধ্যে রিসর্টের ঠিক পিছনে বরোন্তি পাহাড়, আর উল্টোদিকে দীঘির অপর পাড়ে ভালুক পিঠ। এ ছাড়াও উত্তরদিকে আছে বিহারীনাথ পাহাড়। আর এই দীঘি কোনো স্বাভাবিক দীঘি নয়। আগে ছিল ওপেনকাস্ট কোলমাইনস তারপর পরিত্যক্ত অবস্থায় চারপাশের পাহড় থেকে বর্ষার জল জমে জমে দীঘি। তবে জল কিন্তু কাকচক্ষু স্বচ্ছ। মোটকথা বরোন্তি এককথায় খাঁটি পর্যটন গন্তব্য।

সোমেন মনের মতন বিষয় পেয়ে মন দিয়ে ছবি তুলছে। স্যান্ডি দীঘির পাড়ে একটা পাথরে বসে। বুঝলাম প্রকৃতি ওরও মন কেড়েছে। ‘ভিনি ভিনি ভোর’ গুনগুন করছে। মেয়েটা এত ভাল গায়, কিন্তু গানকে কিছুতেই সিরিয়াসলি নিল না। উল্টোদিকের ভালুক পিঠ পাহাড়ের পিছন থেকে তখন সুর্য উঁকি মারছে। একটা পিকচার পার্ফেক্ট ভোর।

সকাল আটটার মধ্যে পুরুলিয়ার এসপি মিস্টার মিনা হাজির। তাতে অবশ্য আমাদের সুবিধেই হয়েছে। স্থানীয় থানার যে মাতব্বররা কাল আমাদের পাত্তা দিতে চাননি তারাই আজ গদগদ। স্যান্ডি এসপি সাহেব-কে বুঝিয়েছে ওর সমস্যার কথা। উনিও সকলকে জানিয়ে দিয়েছেন যে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না আসা অবধি কেউ কলকাতা ফিরতে পারবেন না। আর স্যান্ডি ওনাকে তদন্তে সাহায্য করছে তাই সকলে যেন ওর সঙ্গে সহযোগিতা করেন।

এর মধ্যে আমাকে দুটো লাইভ দিতে হয়েছে। যদিও নতুন কিছু বলার মতন এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলে একই কথা বলে যেতেই হয়। প্রাতরাশের পর স্যান্ডি সকলের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবে জানিয়েই রেখেছিল।

প্রথমেই গেলাম মিসেস দে-র কাছে। ভদ্রমহিলা খানিকটা সামলে উঠেছেন বলেই মনে হল। পুরো নাম সোমা দে। ডাঃ শ্রীলা রাঘবনও ঘরে ছিলেন। স্যান্ডি ওনাকে অনুরোধ করল একটু অন্য রুমে যাওয়ার জন্য।

- আমি বুঝতে পারছি ম্যাডাম, এই অবস্থায় ইটস টাফ ফর ইউ, তবুও…

- না না, আপনি বলুন। কী জানতে চান?

- আপনি নিশ্চয় জানেন ডাঃ দে-র মৃত্যুটা ন্যাচরাল নয়। রাদার বেটার টু সে, পুলিশ এবং আমারও ধারণা ইট ইজ আ কেস অফ হোমিসাইড। কিন্তু কেন? এটা একমাত্র আপনিই খানিকটা হিন্ট দিতে পারেন।

- আমি জানি না কী বলব আপনাদের। ওনার মতন মানুষ হয় না। সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন উনি।

মিসেস দে একটু আনমনা হয়ে পড়লেন।

- রিসেন্টলি কী সামহাউ ডিস্টার্বড ছিলেন?

স্যান্ডির প্রশ্নে খানিক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন মিসেস দে।

- জানি না এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তবে নার্সিংহোম নিয়ে কিছু ঝামেলা হচ্ছিল বলে আন্দাজ পেয়েছিলাম।

- প্লিজ, একটু ডিটেইলসে বলুন।

- নার্সিংহোমে এনারা চারজন পার্টনার ছিলেন।

- মানে ডাঃ দে, ডাঃ দত্ত, ডাঃ মল্লিক এবং মিস্টার রাঘবন?

- হ্যাঁ, কিন্তু ডাঃ দত্ত মানে তাপসবাবু নন। সুমনা। তবে তাপসবাবু আর আমি বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এ আছি।

- হুম, তা প্রবলেমটা কোথায়?

- ওনার কাছে শুনেছিলাম গত বেশ কিছুদিন যাবত্ নার্সিংহোমের ফান্ডে একটা বড়সর গোলমাল হচ্ছে। প্রচুর টাকার হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে এই বরোন্তি বেড়াতে আসার কারণই ছিল সকলে মিলে একটা হেস্তনেস্ত করা। উনি বলেছিলেন এর শেষ দেখে ছাড়বেন। আসার পর ডাঃ তাপস দত্তর সঙ্গে একচোট কথা কাটাকাটিও হয়। যদিও কারণটা আমি জানিনা।

একটানা অনেকগুলো কথা বলে থামলেন মিসেসে দে।

- থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। আপাতত এটুকুই। পরে প্রয়োজন হলে আবার ডিস্টার্ব করব।

আমরা বেরিয়ে আসছিলাম। দরজার কাছে এসে স্যান্ডি হঠাত্‌ থামল। তারপর একটু ইতস্তত করে মিসেস দে-কে আবার প্রশ্ন করল..

- আচ্ছা ডাঃ দে-র এনি আদার পার্সোনাল হ্যাবিট? লাইক বই পড়া, টিভি দেখা, ডায়রি লেখা, এনিথিং? কোনো হবি?

- না, অন্য কিছু নয়। তবে খবরের কাগজের শব্দছক সলভ করা ছিল নেশার মতন। তাছাড়া রিডল, ধাঁধা এগুলো নিয়ে ছেলেমানুষের মতন করতেন মাঝে মাঝে। মানে সাংসারিক কাজের কথার মধ্যেও রহস্য করতেন। আমার যে কী সাংঘাতিক অবস্থা হত..

কথাটা শেষ না করে আনমনা হয়ে পড়েন উনি।

- থ্যাঙ্ক ইউ।

 

-হঠাত্‌ এ প্রশ্ন?

বাইরে এসে জানতে চাই স্যান্ডির কাছে।

- ডাঃ দে কে অ্যজ আ হিম্যান বিয়িং বোঝার চেষ্টা করছি। ডায়রি এটসেট্রায় কোনো ক্লু পাওয়া যেত পারত। বাট নাথিং। অলদ্যো মিসেস দে-র কথায় একটু যেন ‘রে অফ লাইট’.. যাকগে লিভ ইট। লেটস প্যারি অন।

- মানে বলছিস নার্সিংহোমের টাকা নয়ছয়-ই আসল মোটিভ।

- টু আর্লি টু সে। বাট একটা ইম্পর্ট্যান্ট প্রোবাবলিটি তো বটেই।

 

বাইরে আসতেই ডাঃ সমর মল্লিকের সঙ্গে দেখা। একগাল হেসে নমস্কার জানালেন। প্রতিনমস্কার করে স্যান্ডি তার মনোবাসনা জানাল। অর্থাত্‌ কথা বলতে চায়। রিসর্টের সামনের দিকে খোলা জায়গায় ছাতা লাগানো। চমত্‌কার বসার ব্যবস্থা। ওখানেই বসলাম তিনজন। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। সোমেন আর বাবলু বেরিয়েছে কোথাও। আপাতত কোনো লাইভ নেই। নতুন ফিড-ও নেই পাঠানোর। তাই একটু রিল্যাক্স মুডে সবাই।

- আমাদের পুলিশের কী হাল হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। না হলে একজন টেলিভিশন অ্যাঙ্করের সাহায্য চায় তদন্তে!

সমরবাবুর গলায় স্যান্ডির প্রতি শ্লেষ স্পষ্ট। তবে স্যান্ডি পাত্তা দিল না।

- আপনি কি আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?

- বিলক্ষণ, বিলক্ষণ। তবে প্রশ্নের কিছু নেই রহস্য জলবত্‌ তরলম।

- ইজ ইট সো?

- হ্যাঁরে বাবা, হ্যাঁ। আপনি তাপস দত্তকে ধরুন। সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।

- মানে? একটু ক্লিয়ার করবেন প্লিজ।

- রহস্যের জট তাপস দত্তর মিসেস-এ।

- সরি?

- তাপস দত্তর মিসেস-এর সঙ্গে কথা বলুন।

- আয়্যাম স্টিল ইন ডার্ক। বুঝলাম না।

- হুম, এই বুদ্ধি নিয়ে তদন্ত করবে।

কথাটা অসফুটে বললেও আমার কান এড়ায় না। সম্ভবত আমার মুখের কাঠিন্য দেখেই বিগলিত কন্ঠে আবার শুরু করেন সমরবাবু।

- না বোঝার কি আছে! সন্দীপ আর সুমনার তলায় তলায় সম্পর্ক ছিল। অনেকদিনের সম্পর্ক। তা কোন বর তার বউ-এর পরকীয়া মেনে নেবে বলুন! তারপর সোমবার এখানে পৌঁছনোর পরেই তো লেগে গেল দুজনের। মানে তাপস আর সন্দীপের।

- আপনি শুনেছেন, কী নিয়ে লেগেছিল?

- তা শুনিনি তবে তাপস কিন্তু সন্দীপকে শাসাচ্ছিল সেটা শুনেছি।

- একথা পুলিশকেও বলেছেন নাকি!

- আমার যেন আর কাজ নেই। মশাই, তদন্ত করা পুলিশের কাজ আমি বলতে যাব কেন?

- দেন হোয়াই মি!

- আপনি বাচ্চা মেয়ে। আপনি যদি অপরাধীকে ধরে ফ্যালেন তাহলে পুলিশের দৌড়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। তাই আপনাকে সাহায্য করলাম।

- থ্যাঙ্কস। মঙ্গলবার মানে যেদিন বিকেলে সন্দীপবাবু মিসিং হন। আপনি কোথায় ছিলেন?

- আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন? তাহলে সময় নষ্ট করছেন। বলেই তো দিলাম।

- যা জানতে চাইছি বলতে আপনার আপত্তি আছে?

এবার স্যান্ডির গলাটা একটু কড়া হয়। ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত্‌ কনফিডেন্সের আভাষ।

- না আপত্তি নেই। আমি দুপুরে খাওয়ার পরই বেরিয়ে যাই। একটু জয়চণ্ডি পাহাড়ের দিকে গিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে।

- একা?

- হ্যাঁ, সন্ধেবেলা ফিরি।

- চারটে গাড়ি দেখছি। আপনারটা কোনটা?

- ওই ক্রিম কালারের স্কর্পিওটা।

- থ্যাঙ্কস ফর ইওর কো-অপরেশন।

- আবার বলছি তাপস দত্তকে ধরুন।

একট ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে উঠে গেলেন ডাঃ মল্লিক।

- কী বুঝলি, সাক্ষর?

- বুঝলাম ডাঃ মল্লিক বেশ ঘোড়েল লোক।

- হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক, ইজ হি টেলিং ট্রুথ?

- বুঝতে পারছি না।

- হুম, নিড টু থিঙ্ক। তবে বাকিদের সঙ্গে কথাগুলো বলা দরকার।

 

বিশদে না গিয়ে বাকিদের কাছে যা যা জানা গেল তা মোটামুটি এরকম-

ডাঃ তাপস দত্ত। ঝগড়া সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করবেন না। নার্সিংহোমের ব্যাপারে একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কোনো আলোচনা করতে চান না। মঙ্গলবার সারাদিন রিসর্টেই ছিলেন। নিজের রুমে টিভি দেখছিলেন। বাকিরা কে কী করছিল জানেন না। জানার ইচ্ছেও নেই।

ডাঃ সুমনা দত্ত। ডাঃ দে-কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। ওনার তত্বাবধানেই ইন্টার্নশিপ করেছেন। নার্সিংহোমে একটা আর্থিক গন্ডগোল চলছে। ডাঃ দে বলেছিলেন এখানে এসে ফাঁস করবেন। নার্সিংহোমের আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারটা সাধারণত ওনার স্বামী এবং মিস্টার রাঘবন দেখে থাকেন। ডাঃ মল্লিক দেখেন স্টক এবং পার্চেজের বিষয়টা। মঙ্গলবার বিকেলে বেরিয়েছিলেন। একা। গিয়েছিলেন পাঞ্চেত ড্যাম। মন ভাল ছিলনা তাই। ওনার গাড়ি কালো ইনোভা।

মিস্টার রাঘবন। সন্দীপ দে স্কুল জীবনের বন্ধু। নার্সিংহোমের প্রশাসনিক দায় দায়িত্ব বেশিটাই ওনার। কোটি টাকার গড়বর হয়েছে ফান্ডে। কে করেছেন কোনো ধারণা নেই। তবে ডাঃ মল্লিক বা ডাঃ দত্তর করার সুযোগ আছে। সেদিন বিকেলে নিজের সুমো নিয়ে বেরিয়েছিলেন। মুরাডিহ বাজারে মাছ কিনতে গিয়েছিলেন। কাউকে সন্দেহ করেন না। ডাঃ দে মাটির মানুষ ছিলেন।

ডাঃ শ্রীলা রাঘবন। নার্সিংহোমের শুরু থেকেই যুক্ত। টাকা পয়সার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই, তাই জানেন না গণ্ডগোলের খবর। ডাঃ সুমনা দত্ত ডাঃ দে-র নেকনজরে ছিলেন কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। মানুষ হিসেবে ডাঃ দে-র তুলনা হয় না। উনি আর মিসেস মল্লিক ওই দিন বিকেলে গাড়ি নিয়ে ঘন্টাখানেকের জন্য বের হয়েছিলেন। গিয়েছিলেন কাছের একটি সাঁওতাল গ্রামে।

স্বপ্না মল্লিক। বিশেষ কিছুই জানা গেল না। সব কিছুই নাকি তাঁর অজানা। সাঁওতাল গ্রামে যাওয়াটা কনফার্ম করলেন।

 

ধাঁধার বাধা

 

- কিরে কিছু বোঝা যাচ্ছে?

আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল স্যান্ডি। খানিক আগে সুবীর এসেছিল। জানিয়ে গেল পোস্টমর্টম রিপোর্ট আজ রাতেই এসে যাবে। প্রভাবশালী মানুষ হওয়ায় এত দ্রুত কাজ হল। কাল মৃতদেহ পাওয়া যাবে। পুলিশই ব্যবস্থা করছে বডি একেবারে কলকাতায় পৌঁছে দেওয়ার। তার মানে অদ্যই শেষ রজনী। কাল সবাই কলকাতা ফিরবে। এদিকে রহস্য তো যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার ঘরে মিসেস দে-র সঙ্গে দেখা। অনেকটাই সামলে নিয়েছেন। স্যান্ডির সঙ্গে কী কথা বললেন। কিছু একটা দিলেনও।

- কী বললেন মিসেস দে?

- একটা কাগজ দিলেন। বললেন হাতের লেখা ডাঃ দে-র। বাট মিনিংলেস। যদি আমি সলভ করতে পারি তাই দিলেন।

- কই দেখি?

স্যান্ডি কাগজটা বাড়িয়ে দেয়। প্যাডের পাতা। তাতে বিচিত্র কিছু ইংরেজি শব্দ। কিছুই বোঝা যায় না। ঠিক যেভাবে লেখা সেভাবেই তুলে দিচ্ছি।

 

 

Extra caution fatal — please examine vices for kind soul — king’s justice sure : secured — So — just Ignore good judgment — keep extra patience.

 

  

- মানে কী?

- মানেটাই তো খুঁজতে হবে ডার্লিং।

- অতি সতর্কতা মারণ! এ আবার কী?

- ইংরেজিগুলোর বাংলা করলে কিছুই পাওয়া যাবে না বলেই মনে হয়। অন্য কোথাও টুইস্ট আছে। ভুলে যাস না রিডল আর শব্দ ধাঁধা ছিল ওনার প্রিয় বিষয়। ডেফিনিটলি এর মধ্যে কোনো প্যাঁচ আছে।

 স্যান্ডি কাগজটা একমনে দেখতে থাকে।  একই সঙ্গে ল্যাপটপে খুটুর খাটুর করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ একমনে ল্যাপটপ ঘাঁটে। তারপর হঠাত্‌ই ল্যাপটপ, কাগজ গুটিয়ে রেখে উঠে পড়ে।

- বাবলুকে বল বেরবো। সোমেনকেও রেডি হতে বল।

- হঠাত্‌? যাবিটা কোথায়?

- যাব পুরুলিয়া আফ্টার দ্যাট হোম সুইট হোম।

- মানে?

- এখানে থেকে কোনো লাভ নেই। বিশ্বজিতদাকে যা বলার বলে দেব।

- তার মানে স্যন্দিকা মুখার্জি রণে ভঙ্গ দিলেন!

- বালের মতন কথা বলিস না তো। বলেছি এখানে কিছু হওয়ার নেই। যা হওয়ার কলকাতায় হবে। অ্যান্ড আই প্রমিস বাই সানডে মার্ডারার উইল বি অ্যারেস্টেড। কলকাতায় কাল প্রচুর লেগ ওয়ার্ক আছে ডার্লিং।

 

পুরুলিয়ায় এসপি সাহেবের সঙ্গে দেখা করল স্যান্ডি। আমাকে যা বলেছিল একই কথা বলল।

- তার মানে আপনি ধরে ফেলেছেন কে খুনি?

মিস্টার মিনার প্রশ্নে আলতো হাসে স্যান্ডি।

- জাস্ট একটা গেস। তবে সেটা মেলাতেই কলকাতা যাব। আপনি প্লিজ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলে জানাবেন।

- ও শ্যিওর।

 

কলকাতার দিকে রওনা হই আমরা। গাড়িতে উঠেই স্যান্ডিকে চেপে ধরি।

- কিরে, কিছু বলছিস না যে! হঠাত্‌ কী দেখে তুই যবনিকা পাতের ভবিষ্যত্‌বাণী করলি শুনি?

- সেটা তুইও দেখেছিস।

- কী?

- ডাঃ দে-র রিডল।

- তুই সলভ করে ফেলেছিস! বললি নাতো!

- তুইও সলভ কর। একটা ক্লু দিচ্ছি। আপেল।

- আপেল মানে!

জবাব না দিয়ে গম্ভীর হয়ে জানলার বাইরে তাকাল স্যান্ডি। বুঝলাম আর কিছু জানা যাবে না।

 

জটেশ্বরী

 

রাত প্রায় বারোটা নাগাদ স্যান্ডি ফোন করল। আমরা কলকাতা ফিরেছি রাত নটা নাগাদ। 

- সাক্ষর, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানা গ্যাছে।

- কী বলছে?

- কোনো ব্লান্ট কিছু দিয়ে মাথার পিছনে আঘাত করা হয়েছে। সেটাই কজ অফ ডেথ। তারপর বডি ফেলে দেওয়া হয়েছে।

- এতে তোর সুবিধে হল কিছু?

- নাথিং এক্সট্রা। শোন, কাল আমি অফ নিয়েছি বিশ্বজিতদার কাছ থেকে। তুই অফিস করিস। সন্ধ্যেবেলা দেখা করব।

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেটে দেয় ফোনটা। এদিকে টেনশনে আমার মাথা ঘুরছে। আবার রিডল-টা নিয়ে বসলাম। না, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। স্যান্ডি এত তাড়াতাড়ি কী করে সলভ করল কে জানে! এর সঙ্গে আপেল-এরই বা কী সম্পর্ক! ভাগ্যিশ আঙুর, কলা, কমলালেবু বলেনি! তাহলে একেবারে ফ্রুট-স্যালাড হয়ে যেত। বেকার মাথা না ঘামিয়ে শুতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

 

অফিসে ঢুকতেই চারিদিক থেকে প্রশ্নের ঝড়। হত্যা রহস্যের কী হল? যত বলি আমি নিজেও আঁধারে, কে শোনে কার কথা। শেষে যেটুকু জানতাম তাই বললাম। তারপর শুরু হল স্যান্ডিকে ফোন করার চেষ্টা। একজনকে বারণ করি তো আর একজন করে। তবে জানা যায় স্যান্ডির ফোন সুইচড অফ। বুদ্ধিমতি মেয়ে। সারাদিন কাজের মধ্যে দিয়েই কেটে যায়। অবশেষে সন্ধ্যেবেলা স্যান্ডির ফোন এল।

- কাটতে পারবি অফিস থেকে?

- হ্যাঁ। তোর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।

- অলি পাবে চলে আয়। আজ একটু দারু খাব।

ফোন কেটে দেয়। আচ্ছা মেয়েতো!

অলি-র সামনে পার্ক স্ট্রিটে ওয়েট করছিল স্যান্ডি। দেখেই বোঝা যায় সারাদিন প্রচুর দৌড়-ঝাঁপ করেছে। দোতলায় একটা কোণে টেবিল পেয়ে গেলাম সৌভাগ্যক্রমে। এ সময়ে জায়গাই পাওয়া যায় না অলি-তে। স্যান্ডি নিজের জন্য বিয়ার আর আমার জন্য হুইস্কির অর্ডার দেয়। আমি অপেক্ষায় ম্যাডাম কখন মুখ খোলেন। বিয়ার-এ দু তিন চুমুক মারার পর বোধহয় আমার ওপর দয়া হয় স্যান্ডির।

- সকালে গেছিলাম চাইল্ড অ্যান্ড মেটার্নিটি কেয়ার নার্সিং হোমে। ওরা কলকাতায় পৌঁছনোর আগেই কাজ সারা দরকার ছিল। লাকিলি নার্সিংহোম-এর এক স্টাফ আমার ফ্যান তাই কাজটা সহজ হল। বললাম ডাঃ দে-র উপর একটা ফিচার বানাব তাই রেইকি করতে এসেছি। তবে আপাতত যেন ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়।

- কাজ হল কিছু?

- কিছু মানে! অনেক কিছু। প্রায় গোটা রহস্যটাই ফাঁস বলতে পারিস। তারপর গেলাম ব্যাঙ্কে।

- ব্যাঙ্কে? কেন?

- বিশেষ একটি অ্যাকাউন্ট এর ব্যাপারে খোঁজ করতে।

- ব্যাঙ্ক তোকে খোঁজ দেবে কেন?

- এখানেও লাক আমাকে ফেভার করেছে। যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট তার এক বড় কর্তার সঙ্গে কিঞ্চিত দোস্তি আছে।

হাসতে হাসতে চোখ মারল স্যান্ডি।

- এ কেসটার পুরোটাই তো লাকে-র ভরসায় উতরে গেলি।

- আবার বালের কথা। লাক না হলে ঘুর পথে করতে হত। তাতে প্রবলেম হত যে সাসপেক্ট টের পেয়ে যেত। তবে সত্যিই যেখানটা লাক কাজ করেছে সেটা কিন্তু ডাঃ দে-র রিডল। ওটা না পেলে আরও দু-একদিন বেশি সময় লাগত মিস্ট্রি সলভ করতে।

- আবার রিডল। ওটার হাত থেকে আমায় এবার উদ্ধার কর, ডিয়ার!

আমার কাতর আবেদনেও গলল না স্যান্ডির পাষাণ হৃদয়। উল্টে হাসতে লাগল। আচ্ছা বলুন রাগ হয় না!

- ব্যাঙ্ক থেকে গেলাম রেসের মাঠে।

- হুম, এতক্ষণে কেসটা স্বচ্ছ হল।

- গুড, গুড। এই না হলে রিপোর্টার। বল দেখি।

- সাসপেক্ট রেসে প্রচুর টাকা হেরেছে। তারপর নার্সিংহোমের ফান্ড থেকে টাকা সরিয়েছে। কিন্তু ডাঃ দে-র কাছে ধরা পড়ে যায়। তাই হত্যাটা করতে বাধ্য হয়।

- ব্র্যাভো মাই ডিয়ার। পাব্লিক প্লেস না হলে তোকে একটা লম্বা-আ চুমু খেতাম। তা সাসপেক্ট-টা কে সেটা বল?

- সেটা কী করে বলব! রিডল-এর মানে তো জানিস তুই। আমি তো সলভ করতেই পারিনি।

- চাপ নিস না। আর তো একটা রাত। কাল বিকেল চারটে-য় নার্সিংহোমে আই উইল ক্লিয়ার এভরিথিং, ডার্লিং।

- রেসের মাঠ থেকে বেরিয়ে কি আমাকে ফোন করলি?

- না, আগে লালবাজার গেছিলাম, সেখান থেকে মিস্টার মিনাকে ফোনে ধরলাম। উনিও কাল আসছেন। লালবাজারই দায়িত্ব নিয়েছে কাল নির্দিষ্ট সময়ে সকলকে হাজির করানোর। অ্যান্ড দ্যাটস অল ফর দ্য ডে।

 

চিচিং-ফাঁক

 

নার্সিংহোমে ডক্টরস কনফারেন্স রুমে হাজির সবাই। অনেকই যে বেশ বিরক্ত সেটা বুঝতে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার নেই। একমাত্র নির্লিপ্ত ডাঃ সুমনা দত্ত। আজ সোমেন ক্যামেরা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। কেস সলভ হলেই স্যান্ডি লাইভে দাঁড়াবে। রুমে একধার থেকে বসে ডাঃ মল্লিক, ডাঃ দত্ত, স্বপ্না মল্লিক, ডাঃ শ্রীলা রাঘবন, মিসেস দে, সুমনা দত্ত এবং মিস্টার রাঘবন। উল্টোদিকে লালবাজরের দুই বড়কর্তা আর পুরুলিয়ার এসপি সাহেব। বাইরে সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন। সকলের নজরই স্যান্ডির দিকে। স্যান্ডি উঠে দাঁড়ায়।

- আমি জানি অনেকেই বিরক্ত হচ্ছেন। বাট আই কান্ট হেল্প। আই মাস্ট আনমাস্ক দ্য কালপ্রিট।

একটু থেমে সকলের প্রতিক্রিয়াটা দেখে নেয়।

- আপাতদৃষ্টিতে কেসটা জটিল মনে হলেও কালপ্রিট ধরা পড়তই। পুলিশ-ই ধরতে পারত। তবে পারহ্যাপস একটু টাইম লাগত। আমারও লাগত যদি না ডাঃ দে-র শব্দ নিয়ে খেলা করার বাতিক থাকত। আই উইল কাম টু দ্যাট পয়েন্ট লেটার। ডাঃ মল্লিক আমাকে প্রথমেই গুলিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। অবশ্যই ব্যাক্তিগত কারণে। ওনার ম্যাডাম সুমনার প্রতি একটু নেক নজর আছে। তাই ডাঃ দত্ত-র দিকে আমার দৃষ্টি ঘোরাবার চেষ্টা করেছিলেন।

সকলের দৃষ্টি মল্লিকের দিকে। বাকিরা বিস্মিত। সুমনা দত্ত আর স্বপ্না মল্লিকের চোখে আগুনের ঝলক দেখলাম। স্বাভাবিক। সমর মল্লিক অধোবদন।

- পুরো ব্যাপারটাই হয়েছে টাকার জন্য। সামওয়ান ওয়াজ টেকিং মানিটরি অ্যাডভান্টেজ ফ্রম দ্য নার্সিংহোম। ডাঃ দে সেটা ধরে ফ্যালেন। তাই তাঁকে খুন হতে হল। নাও দ্য কোয়েশ্চেন ইজ হু ইজ হি?

একটু থামে স্যান্ডি। তারপর হঠাত্‌ ডাঃ দত্ত-র দিকে ঘুরে তাকায়।

- আপনি রেস খেলেন বলেই যে আপনি টাকা চুরি করবেন এটা তো নাও হতে পারে।

- এক্স্যাক্টলি। আই মিন, সন্দীপকেও তাই বোঝাতে …

হঠাত্‌ থতমত খেয়ে চুপ করে যান ডাঃ দত্ত। প্রচন্ড বিস্মিত মনে হয়।

- অবাক হবার কোনো কারণ নেই। কাল, বিফোর ইউ পিপল রিচ্ড টু কলকাতা আই ওয়াজ ইনভেস্টিগেটিং অ্যাবাউট অল অফ ইউ। সরি আপনাদের চেম্বারেও ঢুকেছি। এবং ব্যাক্তিগত জিনিষ ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। জানেন তো মেয়েদের মাথার ক্লিপ-এর চেয়ে বড় মাস্টার কি আর কিছু হয়না।

এবার অবাক হওয়ার পালা আমার। স্যান্ডি-র এই বিদ্যেটার খবর আমিও রাখতাম না। ডাঃ দত্তকে দৃশ্যতই উত্তেজিত মনে হয়।

- আই মিন, হাউ ডেয়ার ইউ…

- ডোন্ট গেট অ্যাঙ্গরি ডক্টর। না হলে রহস্যভেদ করতাম কী করে! তাছাড়া পুরো কথা না শুনে রি-অ্যাক্ট করার ব্যাড হ্যাবিটটাও বদলানো উচিত। তাহলে ডাঃ দে-র সঙ্গে আপনার বেকার ঝগড়াটা হত না।

- রেস খেললেই চুরি করতে হবে আই মিন, এর কি মানে আছে?

- নেই তো। সেটা আমারও কথা, ডাঃ দে-ও আপনাকে তাই বলতে গেছিলেন। বাট আপনি ওনাকে সম্ভবত কথা কম্প্লিট করতে না দিয়েই রিঅ্যাক্ট করে ফ্যালেন। বরোন্তি যাওয়ার আগেই ডাঃ দে জানতেন কে টাকা নয়ছয় করছে। ঘটনা হচ্ছে যিনি করছেন তিনিও রেসের পোকা। বাট আপনারা কেউ জানেন না।

- মাই গুডনেস, আই মিন কি বলছেন আপনি!

- আজ্ঞে হ্যাঁ, ডাঃ দত্ত। সম্ভবত ডাঃ দে রেস খেলা মানুষের কী ক্ষতি করে এই সংক্রান্ত কোনো উক্তি করাতেই আপনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। উনি আপনাকে ব্লেম করতে নয় আপনার পরামর্শ চাইতে গেছিলেন। বাট আপনি…

কথা শেষ করে না স্যান্ডি। ডাঃ দত্ত বিমূঢ়। এই এসি-র মধ্যেও ঘামছেন।

- এবার আসি মার্ডারারের কথায়। তাঁরও ভয়ঙ্কর রেসের নেশা। বাট কাউকে জানতে দেননি কোনোদিন। আমিও টের পেতাম না যদি না ওনার ড্রয়ারটি খুলতাম। প্রশ্ন হচ্ছে ডাঃ দত্ত-র তো তাহলে জানা উচিত ছিল! উনি রেসের মাঠে নিয়মিত যাওয়া আসা করেন। তাহলে? আসলে আমাদের মাননীয় মার্ডারার মহাশয় মাঠে যেতেন না, অনলাইন বেটিং করতেন। শুধু রেস নয়, ক্রিকেট বেটিং-এও সিদ্ধহস্ত তিনি। মাস আষ্টেক আগে উনি হঠাত্‌ প্রচুর টাকা খুইয়ে বসেন। প্ল্যান ছিল নার্সিংহোমের টাকায় জুয়া জিতে আবার ফেরত দেওয়ার। প্রথম দু মাসে টাকা নিয়েওছেন ফেরতও দিয়ছেন। বাট তারপর-ই শুরু হল লাগাতার পতন। যা সামলে উঠতে পারছিলেন না। এদিকে অডিট-এর সময় এগিয়ে আসছে। তাই ডাঃ দে পেপার্স চেক করতে গিয়েই ওনাকে ধরে ফ্যালেন।

ঘরে পিন পড়লেও শব্দ হবে। সবার চোখ স্যান্ডির দিকে স্থির। একটু জল খায় স্যান্ডি।

- নাও ওয়ান্স এগেন দ্য কোয়েশ্চেন ইজ হু ইজ হি? এখানেই ডাঃ দে-কে আমার স্যালিউট। সেটা উনি ওনার রিডল-এ বলে গিয়েছেন। খুনি অবশ্য চেষ্টা করেছিল যাতে ক্লু না থাকে বাট খুনির সাহায্যকারীর বুদ্ধিতে রিডল-এর মানে ধরা না পড়ায় কাগজটাকে ইগনোর করেন। যেটা মিসেস দে আমাকে দেন। তবে হ্যাঁ, খুনির সাহায্যকারী কিন্তু পার্টনার ইন ক্রাইম নন। জাস্ট ঘটনাটা জেনে নিরুপায় হয়ে হেল্প করতে রাজী হন। এবার বলি ডাঃ দে-র শব্দ-জব্দের মানে। “আমি জানি। কে করেছে। এ রঘুর কাজ”। ওকি মিস্টার রাঘবন। পিস্তল বার করার চেষ্টা একদম করবেন না।

রাঘবন পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল। সেই অবস্থাতেই এসপি মিনা আর লালবাজারের হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ডিসি দুদিক থেকে চেপে ধরেছেন। রাঘবনের কালো মুখ রাগে বেগুনি।

- মিস্টার মিনা। রাঘবনের কেবিন সার্চ করে আর নার্সিংহোমের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেইলস থেকে আমি যা বললাম তার প্রমাণ পাবেন। তবে জানি না কনভিকশনের জন্য এগুলো এনাফ কিনা?

- থ্যাঙ্ক ইউ স্যন্দিকা ম্যাডাম। ইউ হ্যাভ ডান আ ফ্যাবুলাস জব। উই উইল রিমেন গ্রেটফুল টু ইউ। পুলিশ জানে কিভাবে চার্জশিট পেশ করতে হবে।

মিস্টার মিনার চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা। ঘরের প্রায় সকলের চোখেই স্যান্ডির প্রতি সম্ভ্রম।

 

ব্রেকিং, লাইভ সব মিটতে মিটতে প্রায় রাত আটটা। প্ল্যনিং ছিল আজও স্যান্ডিকে নিয়ে অলিতে যাব। আজ আমার ট্রিট। কিন্তু তার আগেই বিশ্বজিতদার নির্দেশ হাজির। যত রাতই হোক অফিস ঘুরে বাড়ি ফিরতে হবে। স্বাভাবিক। বিশ্বজিতদারও ভাত হজম হচ্ছে না। অফিসে ঢুকতেই স্যান্ডি অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে গেল। তবে কেউ কিছু জানতে চাইল না। রিশেপসনিস্ট আমাদের দেখেই জানিয়ে দিল সোজা চিফ এডিটরের ঘরে যেতে হবে। বুঝলাম কেন কেউ কিছু জিগ্যেশ করল না। বিশ্বজিতদার ঘরে ঢুকতেই চমক। ঘরে বসে মিস্টার মিনা। আমরা ঢুকতে না ঢুকতেই চারজনের জন্যে কফি হাজির। এটাও বুঝলাম আমার বস সব প্ল্যান করেই রেখেছেন। তবে সবার আগে স্যান্ডিই রিঅ্যাক্ট করল।

- দাদা আমি সব বলতে রাজি। কিন্তু সোমেনকেও ডাকতে হবে। হি ওয়াজ পার্ট অফ আওয়ার টিম। নাহলে আমি একটি কথাও বলব না।

স্যান্ডির এই প্রতিক্রিয়াটা আমার খুব ভাল লাগল। বিশ্বজিতদা কোনো কথা না বলে ইন্টারকমে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। সোমেন, আর একটি চেয়ার এবং আর এক কাপ কফি হাজির হল। এবার স্যান্ডির মুখে হাসি ফুটল।

- কী ব্যাপার মিস্টার মিনা, আপনি?

- কী করি স্যন্দিকা ম্যাডাম। আপনি তো ফ্ল্যাট করে দিয়েছেন। আপনি কাল যা যা করেছেন তা সব পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক। দুদিন পরে হলেও আমরাও করতাম। কিন্তু বরোন্তি-তে আপনার গেস ওয়ার্ক আর ওই রিডল-এর ব্যাপারটা না জানলে যে আমার ঘুম হবে না ম্যাডাম।

- প্লিজ স্যান্ডি এবার শুরু কর।

কাতর অনুনয় বিশ্বজিতদারও।

- প্রথমেই বলি সাক্ষর সঙ্গে না গেলে আই কুডন্ট হ্যাভ ডান ইট। ও, নট ওনলি ওয়াচড মাই ব্যাক, ওর ইনপুটস ছাড়া আমাদের রিপোর্টিং-গুলো এতো ভাল হত না। আর অবশ্যই সোমেন। ও ছাড়া এত ভাল ছবি কে দিত?

আসল কথা শোনার জন্য সবাই তখন উদগ্রীব।

- রহস্যের বাকিটা সবারই জানা। সকলের প্রশ্ন শুধু রিডল নিয়ে। সাক্ষর আর সোমেন দেখেছে। বাট দে কুডন্ট সলভ ইট।

ও কাগজটা টেবিলের উপর রাখে। বিশ্বজিতদা আর মিস্টার মিনা মন দিয়ে দেখতে থাকেন।

- কী মিস্টার মিনা, সলভ করবেন নাকি? বিশ্বজিতদা?

- তুমিই বলো।

দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠেন।

 

 

   Extra caution fatal — please examine vices for kind soul — king’s justice sure : secured — So — just Ignore good judgment — keep extra patience.

 

- কী বুঝছেন?

সবাই চুপ। আমি তো প্রায় পাগল।

- ওকে আমি-ই বলছি। প্রথমেই বলি এ কথাগুলোর কোনো মানে হয় না। প্রথমত এত ভুল ইংলিশ ডাঃ দে নিশ্চয় লিখবেন না। দ্বিতীয়ত, ক্যাপিটাল আর স্মল লেটারের গোঁজামিল। প্রথম সেন্টেন্স-এর এক্সট্রার E টা ক্যাপিটাল। আবার পরের দুটো সেন্টেন্সের ফার্স্ট ওয়ার্ডের ফার্স্ট লেটারগুলো স্মল। তারপর শুধু সো শব্দটার S ক্যাপিটাল। আবার জাস্ট ইগনোরের আই-টা হঠাত্‌ ক্যাপিটাল। এবার পরের প্রশ্ন। উনি প্রতিটা সেন্টেন্সকে হাইফেন বা ড্যাশ দিয়ে আলাদা করেছেন। রাইট? কিন্তু শ্যিওর আর সিকিওর্ড-এর মাঝে কোলন কেন? তার মানে ওটাও একটা ক্যারেক্টার। সোজা কথায় উনি প্রাচীণতম কায়দা ব্যবহার করেছেন। যেখানে পুরোটাই ক্যামোফ্লাজ শুধু প্রথম অক্ষরগুলোই সত্যি। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? Ecf pevfks kjs:s S jIgj kep। কিন্তু এর মানে কী? হঠাত্‌ মাথায় এলো ডাঃ দে-র ঘরে দেখেছিলাম উনিও ম্যাকবুক প্রো ইউজ করেন আমার মতন। এটা কী তবে অন্য ভাষার কি ওয়ার্ড অ্যাকর্ডিং টু ম্যাকবুক! কারণ ম্যাকবুকে ইউনিকোড টাইপ ইউজ করা হয়। যেহেতু উনি বাঙালি। তাই প্রথমেই আমি আমার ল্যাপটপে বাঙলায় এই কি-গুলো টাইপ করলাম। কী বেরলো দেখবেন? E=আ c=ম f=ি। অর্থাত “আমি”। এবার দেখুন। p=জ, e=া, v=ন, f=ি, k=ক, s=ে। k=ক, j=র, s=ে, :=ছ s=ে। S=এ, j=র, I=ঘ, g=ু, j=র। k=ক, e=া, p=জ। তার মানে দাঁড়ালো- “আমি জানি। কে করেছে। এ রঘুর কাজ।” মিস্টার রাঘবনকে স্কুল জীবন থেকেই যে ডাঃ দে রঘু বলে ডাকতেন এটা জানার জন্য পুলিশ বা গোয়েন্দা কারুরই দরকার নেই। সেটা সবাই জানে, তাই না?

- ও তাই তুই আমাকে ক্লু হিসেবে আপেল বলেছিলিস! অ্যাপেলের ল্যাপটপ বলে। আর আমি তো ফ্রুট স্যালাড ভাবতে বসেছিলাম।

সবাই হেসে ওঠে। স্যান্ডি একচুমুকে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফিটা শেষ করে। এবার কথা ফোটে মিস্টার মিনার।

- স্প্লেন্ডিড, ম্যাডাম।

- কিন্তু রাঘবনের সহকারী-র ব্যাপারে তুই কী বলছিলিস?

প্রশ্নটা না করে থাকতে পারিনা।

- মিস্টার রাঘবন ওনার স্ত্রীকে ফাঁকি দিতে পারেননি। তাই মরিয়া হয়ে স্ত্রীর সাহায্য চান। মিসেস দে-কে দেখভালের সুবাদে ডাঃ শ্রীলা-র সুযোগ-ও ছিল ডাঃ দে-র কাগজপত্র ঘাঁটার।

হঠাত্‌ বিশ্বজিতদা আমার দিকে ঘোরে।

- সাক্ষর, স্যন্দিকা-কে এবার একটা প্রোমোশন দিতেই হয়। কি বলো?

- দাদা, তাহলে ওকেই চিফ রিপোর্টার বানিয়ে দিন। আমি রেজিগনেশন দিয়ে দিচ্ছি।

সমবেত হাসিতে চিফ এডিটরের রুম কেঁপে ওঠে। 

bottom of page