"বাঁধন খুলে দাও" (পর্ব:১)
রিয়া চক্রবর্তী

"আরো একটু বসো তুমি,আরো একটু বলো।
পথিক, কেন অথির হেন - নয়ন ছলোছলো।।
আমার কী যে শুনতে এলে তার কিছু কি আভাস পেলে–
নীরব কথা বুকে আমার করে টলোমলো..."
কোথা থেকে ভেসে আসছে এই গান? এত রাতে? বিনোদিনী উঠে যায় হোস্টেলের জানালার কাছে। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এমন ভরাট গলায় প্রাণ খুলে কে গাইছে? একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ আসছে বাতাসে। দূরে ঐ গাছতলায় ও কে বসে আছে? কিঙ্করদা না? এত রাতে কী করছে? কেমন যেন খ্যাপাটে লোকটা।
প্রথম দিনের ক্লাসে যখন এলো কী ভয়ই না লেগেছিল দেখে। তখনও সবার সঙ্গে সবার চেনা হয়নি। কোণে বসে এক সিনিয়র দাদা এক নারী মূর্তি গড়ছিল। এসেই হাতের এক ধাক্কায় মূর্তিটার বুক দুটোকে ভেঙ্গে দিলেন। বললেন―যাও, আগে দেখে এসো ভালো করে। তারপর গড়বে। এতগুলো মেয়ের সামনে ওভাবে বলে দিলো! সে বেচারা তো তখন আর কারুর দিকে চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। মুখ কাঁচুমাচু করে কোনোক্রমে বেরিয়ে গেল এক ছুটে। কিঙ্করদা এদিকে বলেই চলেছেন―খুঁটিয়ে দেখতে হবে তো সবটা। নইলে গড়বে কী করে?....আরও কতো কী....কিছুই যেন তখন মাথায় ঢুকছে না বিনোদিনীর।
সারাদিন ধরে রোদের মধ্যে মাথায় টোকো দিয়ে ছবি খুঁজে বেড়ান চারপাশে। কখনও কখনও গলা ছেড়ে গান করেন। একা একা শালের বনে বসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বার্নাড শ পড়ে। কুলি কামিনরা দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে―এ বাবু ,চিচাইছিস কেনে?– তাদের বলেন– বুঝবি না, বুঝবি না । একদিন সময় করে তোদের বুঝায় দেবো কেনে। এখন যা, যা, পালা, পালা। – তারপর আবার বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে এক্সপ্রেশন দিয়ে পড়তে থাকেন ।
অদ্ভুত মানুষটা। বিনোদিনীর রক্ষনশীল চেনা গন্ডীতে এমন মানুষের দেখা মেলেনা। তাই যেন এক অদ্ভুত ভয় মিশ্রিত কৌতূহলে জড়িয়ে যায় সে। কখন যে কি করে বসেন কিছুর ঠিক নেই। সেই সেবার ওঁনার জ্বর হয়েছে শুনে অন্যদের সঙ্গে বিনোদিনীও গিয়েছিল কিঙ্করদাকে দেখতে। ওদের দেখে ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়েছিলেন। নানা কথার ফাঁকে হঠাৎই বলে বসলেন– তোমার গড়নটা তো বেশ― বলেই কাগজ নিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে এঁকে ফেললেন বিনোদিনীকে। হুবহু সে। মুগ্ধ হয়েছিল বিনোদিনী, লজ্জা পেয়েছিল। কিন্তু ছবিটা যেন ভর করে বসেছিল মাথায়। কেমন একটা ভালোলাগায় জড়াতে শুরু করেছিল সে। কখন যেন নিজেরই অজান্তে কিঙ্করদার ক্লাসগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করেছিল মনে মনে। কলা ভবনের ছাত্রী সে, স্পেশাল পেপার ভাস্কর্য।
এরপর থেকে কতবার চৈত্রের শালবনে কিঙ্করদার গান তার সঙ্গ নিয়েছে। কালবৈশাখীর মত 'হা–হা'–করে হেসে উঠে বিপুল এক আনন্দকে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে ওর মধ্যে। কখন যেন বিনোদিনী ভালোবেসে ফেলেছে খ্যাপাটে ওই লোকটাকে। কিঙ্করদাও, কখন যেন! হঠাৎ করেই তেলরঙে আঁকা বিনোদিনীর এক ছবি এনে ওর হাতে দিয়ে অবাক করেছে। বিনোদিনী অবাক হয়ে বলেছে–কবে আঁকলে? এমন হলুদ শাড়ি তো আমার নেই?–হেসে বললেন - সেদিন রাত্রে বিনোদিনী তো এই শাড়িটা পড়েই আমার ঘরে এসেছিল। বলেই টোকো মাথায় হন্ হন্ করে আবার চলে গেল। বিনোদিনী শুধু অবাক হয়ে দেখে। কী নিখুঁতভাবে গড়ে তোলেন সব। কী নির্মমভাবে ভেঙেও দেন নিজের সৃষ্টিকে। ভয় করে বিনোদিনীর। তার ঘরও এভাবেই একদিন ভেঙে দেবে না তো চরম অস্থিরতায়?

বিনোদিনী দেবী
রামকিঙ্কর বাইজ
গৌতম সেদিন ইন্দুকে দেখে গান গেয়ে উঠেছিল। যেন কোনো চিন্তাই নেই ওর। কিছুতেই গেল না ইন্টারভিউটা দিতে। সোলো এক্সজিবিশনের জন্য প্রতিদিন একটা করে ছবি আঁকবেই এবার থেকে, কথা দিয়েছিল ইন্দুকে। কিন্তু কই? কিছুতেই যেন কোনো গা নেই ওর । এরম মানুষকে নিয়ে কি আর সংসার করা যায়? কাকু কতবার বুঝিয়েছে ইন্দুকে। দু–একজন ফিরে তাকাচ্ছে ওর গান শুনে। ইন্দু বলে–বন্ধ করো গান। লোকে তোমাকে পাগল ভাববে এবার। এটা পাবলিক প্লেস গৌতম।
গৌতম বলে ওঠে ― ও! আমরা পাবলিক নই বুঝি? বলতে দাও ওদের।
"Indu, why do you run far away from me every now and then? If you have to go, first break free from the bonds of my song."
এভাবেই কথাকে কাটে। এভাবেই প্রতিবার ইন্দু তাকে ঘরের সীমানায় এনে বাঁধতে চায়, আর প্রতিবারই সে ঘরটাকে নাটমন্দির বানিয়ে সীমানা ভেঙ্গে সব কিছুকে মুক্ত, শুদ্ধ করে দিয়ে চলে যায়। সেই মায়ায় জড়িয়ে যায় ইন্দুও। রঙের কারিগর রং লাগিয়ে কথা ভুলিয়ে দেয়।
●
বিনোদিনী জানে তাদের এই সম্পর্ক তার পরিবার মানবে না কখনো। কোথায় মনিপুর রাজ চূড়াচাঁদ সিংহ ও রানি ধনমঞ্জরীর ছোট মেয়ে সে। আর কোথায় বাঁকুড়ার যুগীপাড়ার দরিদ্র নাপিত ঘরের ছেলে রামকিঙ্কর। রামকিঙ্করও হয়তো মনে মনে জানে সে কথা। কম অপমান তো সে সহ্য করেনি ছোট থেকে তাঁর এই জন্ম পরিচয়ের জন্য। এইসব ব্যঙ্গ, শ্লেষ, অপমান থেকে বাঁচতে পদবীটাতেও একটু বদল এনেছে। প্রামাণিক – কে করেছে বেইজ। বৈদ্য থেকে বেইজ। প্রথম শল্য চিকিৎসক তো নাপিতরাই। নিজের ভেতরেই এক হীনমন্যতা যেন বাসা বেঁধে বসেছে। ক্রমে কাজের মধ্যে ডুবতে ডুবতে ভুলেছে সেসব এখন অনেকটাই। নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে প্রতিপদে। নন্দলাল বসু ও গুরুদেবের স্নেহপরশে বদলে গেছে অনেক কিছুই। শিক্ষা শেষে দুটো স্কুলে আঁকার টিচার হিসেবে যোগ দিয়েও সে যে ফিরে এসেছে তার প্রিয় শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হয়ে, সেও তো সম্ভব হয়েছে মাস্টারমশাইয়ের জন্যই। তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় বিনোদিনীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হলে এ তো যথেষ্ট নয়। কিন্তু চেনা সংসারের বাঁধা ছকে যদি সে হাঁপিয়ে ওঠে? বিনোদিনীকে পেতে হলে যদি শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়? শিল্প থেকে দূরে সরতে হয়?-তবে? বাঁচবে কী করে সে? কিন্তু বিনোদিনীকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারেনা রামকিঙ্কর।
দলের সবার সঙ্গে যখন সেবার বেড়াতে গেল, তখন দুজনে অনেকটা সময় কাটিয়েছে নিভৃতে। নিজেকে কার্পণ্যহীনভাবে তার কাছে সঁপে দিয়েছে বিনোদিনী। কিঙ্কর এঁকেছে 'আর্টিস্ট এন্ড দ্য মডেল' ছবিটা। নিরাবরণ ঊর্দ্ধাঙ্গ বিনোদিনীর, ঠোঁটে হাসি। কী সহজ, কী সাবলীলভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিঙ্কর নিজেও আছে ছবিটায়। মাথায় টোকো, হাতে ক্যানভাস। তার মুখ ফেরানো বিনোদিনীর দিকে।

বিনোদিনী ওকে মণিপুর নিয়ে যাবে বলেছে। ওখানে গিয়ে ঘর বাঁধবে ওরা। বাড়িতে বুঝিয়ে বলবে। রাজি করাবে। কিন্তু এই খোয়াই, শালবন, কোপাই আর সাঁওতালদের ছেড়ে কোথাও গিয়ে কি বেশীদিন থাকতে পারবে কিঙ্কর? মন বসবে? বড্ড দোটানায় আছে। কিন্তু এখানে থাকতে গেলে বিনোদিনীকে নিয়ে ঘর বাঁধা একেবারেই অসম্ভব। রোজগারও যৎসামান্য। বড্ড আঘাত পাবে বিনোদিনী।সেই বা থাকবে কী করে? বিনোদিনীকে ছাড়া সব যে শূন্য। জানে না কিঙ্কর কী করবে? কী তার করা উচিৎ?
●
'' ইন্দু আজ একটা ফয়সালা করেই যাবে। এভাবে চলতে পারেনা।'' রাগতভাবে বলল গৌতমকে― তুমি কী চাও আমি চলে যাই তোমাকে ছেড়ে?
গৌতম : তুমি ছেড়ে যাবেই চলে। তুমি তো ঐ ছোট্ট ফুলটার মতন। তোমার সুগন্ধ বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে ঝরে পড়বে মাটিতে। পরমুহূর্তে বলে― না, না, তুমি ঝড়ে পড়বে না। ইন্দু , দ্যাখো চারদিকে বসন্ত তার রঙের ডালা উজার করে দিয়েছে। তবুও আমার কেন এমন কূল ছাপিয়ে কান্না আসছে ইন্দু?
ইন্দু : একবার আমার কথাগুলো একটু শোনো। আমারও তো একটা স্বপ্ন আছে গৌতম। একবার শুধু পরীক্ষা করে দ্যাখো, আমার দেখানো পথে আমরা চলতে পারিনা সফলভাবে? দ্যাখো একবার শুধু।
গৌতম : তুমি আমার শিল্পলক্ষ্মী....কিন্তু বিশ্বাস করো মাঝে মাঝে এই নিয়ম মেনে চলতে হাঁপিয়ে উঠি আমি। মনে হয় পালাই ...তোমার থেকে, এই ক্যানভাস থেকে! "I don't know which is which. Your heart beats in every one of my canvases. But you have to leave. I won't hold you back."
●
রামকিঙ্করেরও যাওয়া হল না বিনোদিনীর সঙ্গে। অদ্ভুত এক উদাসীনতা, প্রচন্ড এক খামখেয়াল ক্রমে গ্রাস করল নিঃসঙ্গ রামকিঙ্করকে । কাজের সূত্রে একবার দিল্লি যাওয়ার সময় নেমে পড়লেন অজানা কোনো জায়গায়। বেশ কিছুদিন পর কলাভবনের এক ছাত্রের কাছে এল তাঁর টেলিগ্রাম―"I lost myself, search me."
ভারত সরকারের পদ্মভূষণ বা বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সন্মান দেশিকোত্তম কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি তাঁকে। সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও ছিল বিপুল অনীহা। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন―
" প্রেম এসেছে জীবনে, সেক্সচুয়াল রিলেশনও হয়েছে। তা কখনোই বলার নয়। কিন্তু একটা জিনিস, কখনও লেপটে থাকিনি। যদি কেউ সত্যি সত্যি কিছু ক্রিয়েট করতে চায়, তাহলে লেপটে থাকলে চলবেনা।...শিল্পীসত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই হয়তো বিয়ে করা হয়নি। ঠিক তাই বা বলি কী করে। বিয়ে করতে গেলে তো অর্থ চাই। প্রচুর অর্থ। ওটাই তো আমার ছিল না।"
(–আমি বিশ্বাস করি আর্ট বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়।।
সাক্ষাৎকার গ্রাহক : সমীর চট্টোপাধ্যায়)

চিত্রাঙ্কন - রামকিঙ্কর বাইজ
রামকিঙ্করের প্রিয় ছাত্র শঙ্খ চৌধুরীর স্ত্রী ইরা ভাকিল মনে করতেন―
"যে মহিলাটির সঙ্গে কিঙ্করদার ভাব হয়েছিল এবং একটা চিরস্থায়ী সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে স্থাপিত হতে গিয়েও হয়নি, তার প্রধান কারণ ওঁর আনওয়ার্ল্ডলিনেসের সঙ্গে সারা জীবন কাটানো অত্যন্ত কঠিন।"
[রং কাঁকর রামকিঙ্কর।। মনীন্দ্র গুপ্ত]
●
আর রাজকন্যা বিনোদিনী? কী হল তাঁর? তিনি মণিপুরে ফিরে গেলেন। বিবাহ করলেন স্বজাতির এক ডাক্তারকে। প্রচণ্ড অসুখী এক দাম্পত্যের মধ্যে বেশ কিছু বছর কাটিয়ে একা হয়ে সরে এলেন। ততদিনে তার দুই সন্তান জন্ম নিয়েছে। নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন শিল্পে, সাহিত্যে। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
এতক্ষণ যে গৌতম ইন্দুর কথা শুনছিলেন, সেটা আসলে একটা নাটকের কিছু সংলাপ। বিনোদিনী তাঁর প্রিয় মানুষটির স্মৃতি ও ফেলে আসা দিনগুলিকে গুছিয়ে তুলে রেখেছিলেন এই নাটকে― 'Crimson Rainclouds'-এ , ইন্দু আর গৌতমের ছদ্মবেশের আড়ালে।
●
বিনোদিনী শান্তিনিকেতনে প্রথমবার এসেছিলেন ১৯৪৫ সালে। একবছর থেকে মণিপুরে ফিরে যান। আবার ফিরে আসেন ১৯৪৭-র আগস্ট মাসে। এবার থাকেন ১৯৪৯-র এপ্রিল অবধি। জীবনের শেষ দিন অবধি তাঁর সংগ্রহে ছিল রামকিঙ্করের আঁকা তাঁর অসংখ্য পোট্রেট। সেই মুখ, সেই অবয়ব, যা রামকিঙ্কর না দেখেও অনায়াসেই সৃষ্টি করতে পারতেন।
রামকিঙ্করের সৃষ্ট বিনোদিনীর সব ছবি, সব ভাস্কর্য রাখা আছে দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট–এ। তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে হয়তো দেখবেন এক শিল্পীর অনন্ত প্রতীক্ষা আর এক রাজকন্যার গভীর ভালোবাসা পরস্পরের মধ্যে একাত্ম হয়ে গেছে। কান পাতলে হয়ত হঠাৎই শুনতে পেলেও পেতে পারেন সেই গান, যা এক পাগল শিল্পী প্রাণটুকুকে উজাড় করে দিয়ে গাইছেন, দরাজ কন্ঠে, তাঁরই রাজকন্যার জন্য―
" হায় অতিথি, এখনি কি হল তোমার যাবার বেলা।
দেখো আমার হৃদয়তলে সারা রাতের আসন মেলা।।
জানালে না গানের ভাষায় এনেছিলে যে প্রত্যাশা।
শাখার আগায় বসল পাখি, ভুলে গেল বাঁধতে বাসা।"
[ চলবে.................. ]