"বাঁধন খুলে দাও" (পর্ব:2)

রিয়া চক্রবর্তী
‘মেরি শওকত,
এক বাজে তুমকো এক খৎ লিখকে লিফাফা বন্ধ কিয়া। অউর লেটা কে শায়েদ সো যায়ু। লেকিন নিন্দ নেহি আয়ি। ফির তুমহারে খৎ পড়হে অউর বেইকতহার আঁশু নিকল আয়ে। শওকত তুমকো মুঝপর ভারোসা নেহি? ইয়া মেরি মহব্বত্ পর এইতবার নেহি? ইয়ে মেরি বদনাসিব নেহি তো অউর ক্যা হ্যায়?’
(শওকত আমার,
তোমার জন্য লেখা চিঠি যখন খামবন্ধ করলাম, তখন একটা বাজে। তারপর শুয়েছিলাম ঘুমিয়ে পড়ব বলে। কিন্তু ঘুম এলো না। আবার তোমার চিঠিটা পড়লাম। কেবলই চোখে জল আসছিল আমার। শওকত আমার ওপর কোনও ভরসা নেই তোমার? নাকি আমার ভালবাসার প্রতি তোমার কোনও বিশ্বাস নেই? এটা আমার দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী?)
‘সমঝমে নেহি আতা কে তুমকো মেরি মহব্বতকা ক্যায়সে ইয়েকিন দিলায়ুঁ। ফির এক বাত মেরি সমঝমে আয়ি। ব্লেড লে কার আপনি কলহাইকে উপার এক গ্যাহরা জহকম ডালা, অউর খুন সে তুমকো খৎ লিখ রাহা হুঁ। অবতক তুমহারি মহব্বতমে আঁশু বাহায়ে থে। অব খুন। আগে আগে দেখিয়ে হোতা হ্যায় ক্যায়া...’
( বুঝতে পারছিলাম না আমার ভালবাসার প্রতি তোমার আস্থা আমি কী করে অর্জন করব। তারপর একটা পথ পেলাম। ব্লেড দিয়ে নিজের শিরার ওপর একটা গভীর ক্ষত তৈরি করে, সেই রক্ত দিয়ে এখন তোমাকে এই চিঠি লিখছি। তোমায় ভালবেসে এতদিন চোখে জল এসেছিল। এখন রক্ত। দেখতে থাকো আগামীতে আরও কী কী হয়...)
বড্ড বিচলিত হয়ে পড়ল শওকত এই চিঠি পড়ে। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। চোখের জল কিছুতেই যেন বাঁধ মানছে না। কেন সেদিন সে ওভাবে বলল কাইফিকে? এত রূঢ় শব্দ বলবার আগে কেন তার জিভ, তার কন্ঠ, তার চেতনা নিথর হয়ে গেল না? চায়নি সে এভাবে বলতে....কখনও না......কী করে এখন সে! কাইফি যদি আরও বড় কোনও পাগলামি করে বসে! একবারও কি বুঝবে না সে তার মনের তোলপাড়টা? কেবল বাইরের কথাগুলোই সত্যি হল তার কাছে? বুঝবে না তার লড়াইটা? তার দন্দ্ব?
●
ছোট এগারো বছরের ছেলেটা সেদিন খেলা ফেলে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল মুশেয়ারা কক্ষের দরজায়। শায়েরির মাথায় কেমন যেন জড়িয়ে গিয়েছিল সে সেই কবে থেকেই। চুপি চুপি তারপর থেকে দু–এক পংক্তি শের লেখার চেষ্টা করেছে। কী নিবিড় এক লজ্জায় লুকিয়ে রেখেছিল সেসব সবার কাছ থেকে এতদিন। ঘরের মধ্যে একবার উঁকি দিল সে। মনোহর চাচা বই দেখে কোনও এক কবির একটা শায়েরি পড়ছে। ছেলেটা চেনে না সেই শায়ের কে। দেখছে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে সেই পংক্তি। হঠাৎ করেই কে একজন আলতো করে তার মাথায় হাত রাখল।


— হাতে কী রে তোর খোকা?
ছেলেটা ফিরে তাকালো। পশ্চিমপাড়ার এই চাচার নামটা সে জানে না। শুধু মুখটা চেনে। হাসিতে কৌতুক এনে চাচা বলল—
— শায়েরি বুঝি? তোর লেখা?
মাথা নাড়ল ছেলেটা। চাচার অমায়িক হাসি আরও একটু চওড়া হল।— আরে বাহ্! নাম কি তোর? কাইফি, কাইফি আজমি। অন্যদের সঙ্গে কথা বলে কিছু পরেই তাকে ডেকে নেওয়া হল আসরের মধ্যিখানে। বুক ডিপডিপ করছে কাইফির। তবু সে পড়তে শুরু করল—
‘‘ইতনা তো জিন্দেগি মে কিসি কে খলাল পড়ে
হাস্নে সে হো সত্তকুল না রোনে সে কাল পড়ে
জিস তরহা হাস্ রাহা হুঁ ম্যায় পি পি কে গর্ম্ আশ্ক্
ইউ দুসরা হাসে তো কলিজা নিকল্ পড়ে’’
[জীবনে এমন দিন যেন কেউ না দ্যাখে যে
হাসির চেয়েও কান্নাতে তার আনন্দ হয় বেশী
নোনতা চোখের জলের ধারায় আমি যেমনভাবে হাসতে পারি—
তেমন অন্যের আনন্দেও যেন উদ্বেল হতে পারি
(অনুবাদ: শমীক গোস্বামী)]
মুগ্ধ সকলে। সামনের সারির থেকে এক বৃদ্ধ প্রশ্ন করলেন—
— কার লেখা পাঠ করলে খোকা?
— আমার
সকলেই অবিশ্বাস ভরে তাকালো ওর দিকে। ওর তখন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। জল অনেক দূর গড়ালো। সকলেই ভাবছে হয়তো তার বাবা বা দাদা লিখেছে এ শায়েরি। অবশেষে দাদা এসে জানালো এ পংক্তি তার এগারো বছরের ভাইয়ের লেখা।
জীবন তারপর চড়াই–উৎরাই ধরে এগিয়ে চলল ক্রমে গলিপথ ছেড়ে রাজপথের দিকে। স্বদেশী আন্দোলন, বামপন্থা আন্দোলনের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে কাইফি তার গ্রাম ছেড়ে ক্রমে বৃহত্তর জনজীবনের মাঝে এসে পড়ল। পার্টির কাজ, মানুষের জন্য কাজ আর তারই কোনো অবসরে শায়েরি লেখা। এভাবেই দিনগুলো বড় দ্রুত এগোতে থাকল। এভাবেই কাজের অবসরে এক মুশেয়ারার আমন্ত্রণে সেদিন হায়দ্রাবাদ এসেছে সে...
●
বড্ড আদরে মানুষ হয়েছে শওকত। গান, অভিনয়, বন্ধুত্ব, প্রাচুর্য আর পরিবারের নিবিড় ছায়ায় দিনগুলো স্বপ্নের মতো কেটে যাচ্ছে যেন। তার কবিতা নিয়ে পাগলামি, শায়েরি পড়ার সখ নিয়ে সহেলিরা কম খ্যাপায় না ওকে। বাবার ‘পেয়ারি বেটি’ শওকত সেদিন গেছে এক মশেয়ারায়, শায়েরি শুনবে বলে, তারই আজন্মের প্রিয় শহরের হায়দ্রাবাদে।
একের পর এক শায়েরি শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই চোখ আটকে গেল মঞ্চের শায়েরের দিকে। মায়াবী কন্ঠে যে পড়ছে তার আজকের শায়েরি। শওকত মুগ্ধ হয়ে শুনছে, শায়েরের কন্ঠ, ব্যক্তিত্ব, স্বপ্নালু চোখ দুটো তাকে অদম্য এক টানে টানছে যেন। এই মানুষটাকেই তার চাই। আজীবনের পথ একমাত্র এই মানুষটার সাথেই। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। মুশেয়ারার ভাঙা হাটে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে শওকত, কাইফির সঙ্গে কথা না বলে সে কিছুতেই বাড়ির পথে পা বাড়াবে না। কাইফি তাকে খেয়ালও করেনি। কথা বলছে বাকি শায়েরদের সঙ্গে, দর্শকদের সঙ্গে। আচ্ছা, নতুন শায়ের কি তার গাওয়া গান কখনও শুনেছে? দেখেছে তার অভিনয় করা থিয়েটার?
●
সেদিন কাইফি আর শবনম গিয়েছে এক বড়ো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের বাড়িতে, সান্ধ্য নিমন্ত্রণ। সঙ্গে দশ–এগারো বছরের তাদের মেয়ে শাবানা। বাড়ীর কর্ত্রী সাহেবের সেই সুন্দরী স্ত্রী সেদিন কাইফিকে ‘হো নিগাহোঁ কা...’ গানটা গাইতে অনুরোধ করলেন, বিত্ত এবং সৌন্দর্যের জন্য সোসাইটিতে বেশ খ্যাতি ও খ্যাতির আছে কাইফির এই অনুরাগীনিটির। অনুরোধ করেই অবশ্য ক্ষান্ত হলেন না। সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘‘জানেন, এই গীতটা কাইফি সাহেব আমার প্রশংসায় লিখেছেন।’’— কাইফি চোখের পলকমাত্র ফেললেন না সে কথা শুনে। যেমন গাইছিলেন, গাইতেই থাকলেন, কিন্তু শাবানা আর নিতে পারলো না। চিৎকার করে বলে উঠল— ‘‘মিথ্যে কথা! এই গীত আব্বা আমার মাম্মীর জন্য লিখেছেন, ওই মহিলার জন্য নয়।’’— বলেই সে মাম্মী শওকতের দিকে তাকালো। দেখলো মাম্মী ইশারায় তাকে চুপ করতে বলছেন। পরে মা তাকে বোঝান যে, ‘‘শায়েরদের নিজের গুণমুগ্ধদের সঙ্গে এক আলাদা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদি সেই মহিলা ভেবে থাকেন যে, সেই গীত তাঁর উদ্দেশে রচিত হয়েছে, তাহলে তাঁকে খুশি থাকতে দাও, মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়বে না।’’

ছোট্ট শাবানা কী করে জানবে শওকত কত যুদ্ধ করে কাইফির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কত ঝড় এসেছে, তবুও ইলাতে পারেনি তাকে। কাইফি প্রথম দিনেই তার প্রস্তাব শুনে জানিয়েছিল তার আয় মাসে পঁয়তাল্লিশ টাকা। শওকত যে বৈভবে মানুষ, সে পারবে কী করে তার সঙ্গে পথ চলতে? অবাক হয়ে কাইফি দেখেছিল মেয়েটা অবলীলায় বলছে প্রয়োজনে সে মজুরের কাজ করবে, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত থেকে সে সরবে না কিছুতেই। আর বাঁধা দিতে পারেনি কাইফি। মেনে নিয়েছিল। শওকতের বাড়ির লোক মানতে চায়নি এ সম্পর্ক। বিরোধ ক্রমে ক্ষত সৃষ্টি করেছে শওকতের পরিবারে। তবুও শওকত সরে আসেনি তার নিজের সিদ্ধান্ত থেকে।
●
সেদিন পি. সি. জোশি এসেছেন কাইফির কাছে। কাইফি আর শওকত এখন থাকে কমিউনিস্ট পার্টির ‘রেড ফ্ল্যাগ হল’–এ। নতুন পাতা সংসার। শওকত আপ্রাণ ঘাটছে। রোজগারের আরও চেষ্টা করছে। কাইফিও এক নতুন কাজ নিয়েছে। প্রতিদিন সকালে ‘মজাইয়া নজম’ নামে এক নিউজপেপারে ডেইলি কলাম লিখছে। ভোরে উঠছে সে কারণে। তারপর তো ঘুরে ঘুরে পার্টির কাজ আছেই। জোশির জন্য চা করে নিয়ে এসেছে শওকত। একটু পরেই রান্না শেষ করে নাটকের পার্ট ঝালিয়ে নিতে বসতে হবে। ওটাই তো তার রোজগারের পথ। যতই ক্লান্তি আসুক, হারবে না সে কিছুতেই। জোশি তাকে বললেন— ওকে দিয়ে এতো কাজ করিও না হে। কাইফির দিকেও একটু দ্যাখো। বেচারা সারাদিন পার্টির কাজে থাকে, তার উপর এই কলাম লেখা সংসারের জন্য...। আঘাত পেলে শওকত, আর একটা লাইনও লিখতে দিলো না ঐ কলামে কাইফিকে। আরো একটা দলে কোরাস গান করার কাজ নিল শওকত। মাসে মাসে ত্রিশ টাকা পাবে তাতে। জানে শওকত তবেই না কাইফি লিখতে পারবে— ‘‘ওয়াক্ত নে কিয়া কেয়া হাসি সিতম/ তুম রহে না তুম, হাম রহে না হাম’’ কিংবা ‘‘তুম ইতনা যো মুসকুরা রহে হো/ কেয়া গম হ্যায় জিসকো ছুপা রহে হো’’–র মত গজল। সারা হিন্দী চলচ্চিত্র জগৎ তবেই না তাকে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকবে। শওকত কি জানে না কাইফির চোখে সবই ধরা পড়ে। তার সব ওঠাপড়া, যুদ্ধগুলোকে সে স্নেহভরে, শ্রদ্ধা ভরে দেখে। শওকত কি জানে না এইসব শব্দবন্ধের আড়ালে আসলে কে আছে? কাকে ভেবে কাইফি সাহেব এমন সব শায়েরি লেখেন।
●
বহুদিন পার হয়ে গেছে। পুরনো আসবাব গোছাতে গোছাতে সেদিনের সেই রক্তে লেখা চিঠিটা হঠাৎ হাতে এসে পড়লো শওকতের। কী ভয়টাই না সে পেয়েছিল সেদিন। জীবন এখন স্বচ্ছল। সেই দিনগুলো মিঠে স্মৃতি হয়ে আটকে আছে আজও তার মনের কোণে। চিঠিটা নিয়ে বাবার কাছে ছুটে গিয়েছিল সে। বাবা বলেছিলেন— কবিদের ওসব কথা বিশ্বাস কোরো না। হয়ত দেখ কসাইখানায় গিয়ে কোনো ছাগলের রক্ত জোগাড় করে লিখেছে। আর নিজে আরাম করে আয়েশে বসে তোমায় অস্থির করতে চাইছে।— ভাবলে হাসি আসে এখন। শওকত কিন্তু সেদিনও জানতো কাইফি মিথ্যে বলেনি। কাইফি ওর জন্য সব পারে। তাই না ঐ দুর্দান্ত প্রেমিক মানুষটা অবলীলায় লিখতে পারে বেদনার সেরা গানগুলো।
●
হাওয়ায় পর্দা উড়ছে, কাইফি আজও লিখছেন তার পাশের ঘরে বসে। শওকত আজও নিশ্চিন্ত। ছেলে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত আজ। খ্যাতি, যশ, প্রাচুর্য সবই এসেছে। লড়াই করে তারা জিতে গেছে জীবনের বাজিটা। পরম তৃপ্তি আজ শওকতের মুখমন্ডলের বলিরেখায়। দূর থেকে ভেসে আসছে কাইফির লেখা তার বড় প্রিয় একটা গান—
‘‘কোয়ি ইয়ে ক্যায়সে বতায়ে কি উও তন্হা কিঁউ হ্যায়
উয়ো যো আপনা থা উও অউর কিসি কা কিঁউ হ্যায়
ইয়েহি দুনিয়া হ্যায় তো ফির অ্যায়সি ইয়ে দুনিয়া কিঁউ হ্যায়
ইয়েহি হোতা হ্যায় তো আখির ইয়েহি কিঁউ হ্যায়
................................
তুম মাসার্রাত কহো ইয়া, ইসে গম্ কা রিস্তা
কহেতে হ্যায়, প্যায়ার কা রিস্তা হ্যায় জন্ম কা রিস্তা
হ্যায় জন্ম কা যো ইয়ে রিস্তা তো কট্তা কিঁউ হ্যায়?’’
[কীভাবে কেউ বলতে পারে ও আজ এমন নিঃস্ব কেন?
একান্ত যে নিজের ছিল, পরের আপন আজ সে কেন?
একেই যদি দুনিয়া বল, দুনিয়া তবে এমন কেন?
এটাই যদি হওয়ার, তবে এমনটা হয় যে কেন?
.....................
যে নামে খুশি ডাকো একে— সুখ অথবা দুখের বাঁধন
বলে লোকে ভালোবাসার বাঁধন নাকি আজীবনের সাধন
আজীবনই যদি, তবে ছিন্ন হয় সে বাঁধন কেন?]