দেবীপুর। আলিপুরদুয়ার জেলায় অবস্থিত। নেহাতই গন্ডগ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে নদী। ডিমা। সদ্য পাহাড় থেকে সমতলে নামা। যার অপর পাড়ে ঘন অরণ্য। মিশে গিয়েছে দেওয়াল তোলা পাহাড়ের গা-এ।
প্রকৃতির অ-কৃপণ রূপ ছাড়া এই গ্রামে দেখার মতন জিনিষ আর একটিই আছে। চৌধুরী ভিলা। লোকের মুখে মুখে যা হয়ে দাঁড়িয়েছে চৌধুরী গড়। গড়ই বটে। দুর্ভেদ্য বাড়ি। নাকি প্রাসাদ বলা ভাল! সুবিশাল গেট। তার মধ্যেই প্রাসাদোপম বাড়ি। যার পিছনে ভারী সুন্দর বাগান একখানা। অনেকটা জায়গা জুড়ে। তবে সেখান থেকে পিছনের নদী বা পাহাড় দেখা যায় না। কারণ উঁচু পাঁচিল। তবে বাড়ির দোতলার ঘর থেকে ভারী সুন্দর দৃশ্য। ঘরের পিছনে ছোট এক চিলতে ব্যালকনি। সেখানেই দাঁড়িয়েছিল স্যান্ডি। স্যন্দিকা মুখার্জি।
হাওয়ায় হিমেল পরশ। গায়ের চাদরটাকেই তাই আরও ঘনিয়ে নেয় নিজের সঙ্গে। আজই দুপুরে এসে পৌঁছেছে স্যান্ডি, কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে। আলিপুরদুয়ার জংশনে গাড়ি ছিল। চৌধুরীবাবুর নিজস্ব গাড়ি। মারুতি জিপসি। স্যান্ডির এবারর আসাটা না ছুটি কাটানো, না তদন্তে আসা। কলেজের বন্ধু বাবুলের চাপে পড়ে দিন দুয়েকের জন্য দেবীপুরে আসতে বাধ্য হয়েছে স্যান্ডি। বাবুল অবশ্য সাক্ষরকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু স্যান্ডি ম্যানেজ করতে পারলেও সাক্ষর ছুটি পায়নি। চিফ রিপোর্টারের কাজের চাপ একটু বেশিই হয়।
বাবুল। ভাল নাম তমোঘ্ন চৌধুরী। স্যান্ডির ব্যাচমেট ছিল সেন্ট জেভিয়ার্সে। তারপর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। বাবুল এখন এক নামী এমএনসি-তে সিনিয়র ম্যানেজার। অবশ্য ওর চাকরি না করলেও চলে। বাবা তরুণ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বছরের সিংহভাগ কাটে বিদেশে। বাবুল থাকে নিউ আলিপুরের এক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। এখনও অকৃতদার। ফ্ল্যাট অবশ্য বাবারই কিনে দেওয়া।
সপ্তাহ খানেক আগে চ্যানেল ফাইভের মেক-আপ রুমে হঠাত্ অ্যাসাইনমেন্টের শৌনক।
- স্যান্ডিদি, এক ভদ্রলোক ফোন করে তোমার সেল নম্বর চাইছেন। বলছেন কলেজের বন্ধু।
শৌনক ঠিকই করেছে। জিগ্যেশ না করে কারো নম্বর দেওয়ার নিয়ম নেই। স্যান্ডি তখন মেক-আপ তুলছিল। আয়নার মধ্যে দিয়ে একটু অবাক চোখেই তাকায় শৌনকের দিকে।
- নাম কী বলছে?
- তমোঘ্ন চৌধুরী।
- ভাগ কে না কে…
কথাটা অসমাপ্ত রেখে আবার মেক-আপ তোলায় মন দেয় স্যান্ডি।
- বললেন বাবুল বললে তুমি হয়তো চিনবে…
শৌনক কেমন যেন ইতস্তত করে। স্যান্ডি চকিতে ঘুরে তাকায়।
- হারামি-টা বেঁচে আছে!
তারপরই খেয়াল হয় শৌনক, মেক-আপম্যান তাপসদা এবং আর এক অ্যাঙ্কর অনসূয়া অবাক চোখে দেখছে ওকে। হেসে ফেলে স্যান্ডি।
- যা যা নম্বরটা দে। আর বল মিনিট দশেক পরে ফোন করতে।
শৌনক চলে যায়। স্যান্ডি হাসিমুখে তাপসদার দিকে ফেরে।
- আরে মহা বিটলে ছিল। বাট নেভার হার্ড অফ হিম আফটার কলেজ ডেজ।
সেদিনই রাতে ফোন করেছিল বাবুল।
- স্যান্ডি, বাবুল বলছি রে।
- উফফ, আফ্টার সাচ আ লং টাইম। কেমন আছিস?
- সে সব কথা পরে হবে। কুড ইউ মিট মি টুমরো? সে, অ্যারাউন্ড সেভেন। ইভিনিং?
- কোথায়?
- পার্ক স্ট্রিট, বরিস্তা?
- ডান।
না, স্যান্ডি জানতে চায়নি কী ভাবে বাবুল ওর খোঁজ পেল। সেটা বড়ই বোকা বোকা হত। ওর মতন পরিচিত টিভি ফেস খুঁজে পেতে কোনো রকেট সায়েন্স জানার দরকার হয় না। দেখা হওয়ার পর বাবুল এক বিচিত্র প্রস্তাব দিল। ওর সঙ্গে আলিপুরদুয়ার যেতে হবে। কারণ হিসেবে বাবুল যা জানাল তাতে বাবুলের মনে হলেও স্যান্ডি কোথাও কোনো রহস্যের ইঙ্গিত পায়নি।
বাবুলের বাবা তরুণ চৌধুরীরা দুই ভাই। তরুণবাবু ছোটো। তপন চৌধুরী বড়ো। উত্তরাধিকারসূত্রে দুই ভাই বিপুল সম্পত্তির মালিক হন। এরপর বাবুল যখন মাত্র ছ বছরের সে সময় ওর মা মারা যান। তারপরই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দুই ভাইয়ের মনোমালিন্য এবং মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ছেলেকে নিয়ে তরুণবাবু কলকাতা চলে আসেন। দুই ভাইয়ে সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় এসে তরুণবাবু নিজের ব্যবসা শুরু করেন। কঠিন শ্রম, অধ্যাবসায় আর কিঞ্চিত কপালের সহযোগিতায় ব্যবসা দাঁড়াতে সময় লাগেনি। এমনকি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রসার পেতে থাকে ব্যবসা। তরুণবাবু আর বিয়ে করেননি। ছেলে আর একটু বড় হলে তাকে হোস্টেলে রাখার ব্যবস্থা করেন। কারণ ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তখন তাঁকে প্রায়ই ছুটতে হচ্ছে কলকাতার বাইরে। এমন কি বিদেশেও। বাবুল যখন ক্লাস নাইনে তখন হঠাত্ আবার তার জ্যাঠামশায় যোগাযোগ করেন। করেন সরাসরি বাবুলের সঙ্গেই। ভাইকে এড়িয়ে। তাকে আলিপুরদুয়ার ডেকে পাঠান। তরুণবাবু প্রথমে আপত্তি করলেও বাবুলের আগ্রহ দেখে মানা করেননি। তবে তিনি নিজে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আসলে বাবুলের ছোটবেলার স্মৃতি বলতে ওই জ্যাঠামশাই। নিঃসন্তান জ্যাঠামশাইয়েরও চোখের মণি ছিল বাবুল। আশ্চর্য হওয়ার মতন ঘটনা যে সেই জ্যাঠামশাই প্রায় আট বছর বাদে যোগাযোগ করলেন। জানা গেল ততদিনে জ্যাঠাইমা-ও গত হয়েছেন। বাবুল গিয়েছিল আলিপুরদুয়ার। তারপর থেকে প্রতি বছরই ছুটিতে যায়। বিচ্ছিন্ন দুই ভাই এর মধ্যে একমাত্র মিসিং-লিঙ্ক ও। ভাইয়েরা কেউ কারো খোঁজও করে না। ও নিজে কয়েকবার চেষ্টা করতে গিয়ে বিফল হয়ে থেমে গিয়েছে। বাবুলের জ্যাঠামশাইয়ের জুয়েলারির ব্যবসা। আলিপুরদুয়ারের সব থেকে বড় শো-রুমটি ওনারই। এছাড়াও সমাজে প্রতিপত্তি অসীম। মাঝে রাজনীতিতেও জড়িয়ে ছিলেন। পর পর দুবার বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জেতেনও। তারপরই রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ সন্ন্যাস গ্রহণ। তবে তাতে প্রভাব কমেনি এক রতিও। দেবীপুরের পৈতৃক বাড়ি ছাড়াও আলিপুরদুয়ার শহরে বাটা মোড়ের কাছে আছে আরও একটি প্রাসাদোপম বাড়ি। এটি অবশ্য ওনার নিজেরই নির্মাণ। সাধারণত এ বাড়িতেই থাকেন। সপ্তাহান্তে দেবীপুর যান।
বাবুলের মতে রহস্যটা গত সপ্তাহে ক্যুরিয়রে আসা জ্যাঠামশাইয়ের চিঠি। খামের মধ্যে বাবুলের জন্য একটি চিঠি। এবং আর একটি মুখ বন্ধ খাম। ওর বাবার নাম লেখা। বাবুল যথেষ্ট অবাকই হয়। ওর চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত। ও যেন কালবিলম্ব না করে মুখ বন্ধ খামটি বাবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
এরপরে বাবাই ওকে জানান যে তাঁর দাদা সব মিটিয়ে নিতে চেয়েছেন। অবিলম্বে দেখা করতে চান। পরের শনিবার পুনর্মিলনের আনন্দে দেবীপুরের বাড়িতে একটি পার্টিরও আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে বাবুলকেও উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। চাইলে সে দু-চারজন বন্ধু বান্ধবও নিয়ে যেতে পারে। এখানে স্যান্ডি প্রথম বাধা দেয় বাবুলের কথায়।
- ওকে। বুঝলাম। বাট হোয়্যার ইজ ইয়োর মিস্ট্রি!
- সেটাই মিস্ট্রি।
- মানে?
- ফার্স্ট অফ অল, জেঠুর এই হঠাত্ ট্রুস-এর প্রস্তাব। দ্বিতীয়ত তরিঘরি পুনর্মিলনের আয়োজন। তাও আবার পার্টি দিয়ে।
- হুম। বাট বাবুল, আই হ্যাভ আ স্ট্রং ফিলিংস, তুই বাল কিছু চেপে যাচ্ছিস।
- ও, তোর খিস্তি করার রোগটা এখনও আছে?
- কথা ঘোরাবি না।
- আসলে বলতে পারিস এটাও একটা মিস্ট্রি।
- কী যাতা বকছিস? খুলে বলবি নাকি?
- আমাদের কোনো পারিবারিক সম্পদ আছে। আই ডোন্ট নো সেটা কী? বাবা বা জেঠু কেউ এ ব্যাপারে মুখ খোলে না। জিগ্যেশ করতে গেলে বিরক্ত হয়। বাট বাড়ির পুরনো কাজের লোকেরাও জানে। তবে নট ইন ডিটেইলস। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কেমন একটা হাশ হাশ ভাব। আই ডোন্ট নো। তুই চল।
- আমি গিয়ে কী করব!
এবার অবাক হয় স্যান্ডি।
- কিছু না, জাস্ট দুদিনের জন্য বেড়াতে যাবি। ইটস আ নাইস প্লেস। এখন তো তোদের খবরের বাজারও গরম নয়। তোর বয় ফ্রেন্ডকেও নিয়ে চল। অল পেইড ট্রিপ।
চোখ টিপে হাসে বাবুল।
শেষে বাবুলের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে না পেরে গত রাত্রে ওর সঙ্গেই শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে। বাবুলের বাবা আগের দিনই এসেছেন। ব্যবসার কাজে গ্যাংটকে ছিলেন। সেখান থেকেই। চাদরটাকে আরও একটু টেনে নেয় স্যান্ডি। ঠান্ডাটা বেশ চেপে ধরেছে। একটা সিগারেট ধরায় ও আনমনে। এ বাড়িতে অনেকগুলো ঘর। এক্স্যাক্টলি কতগুলো এখনও জানে না স্যান্ডি। তবে বাড়ির আয়তন, আর একতলার যতটুকু চোখে পড়েছে তাতে এটুকু পরিষ্কার, একে বাড়ি না বলে রাজবাড়ি বলাই ভাল। ওকে দেওয়া হয়েছে দোতলার একদম বাঁদিকের ঘরটা। বেশ বড়। পুরনো বাড়ি। সিলিং হাইটও ভালই। ঘরের পিছনের একচিলতে ব্যালকনিটা ওর মন কেড়ে নিয়েছে। ঘর থেকেই এক পাশের জানলা দিয়ে দূরের গ্রামটা দেখা যায়। নেহাতই নিম্নবিত্তদের গ্রাম। বাড়িটা গ্রামের থেকে একটু বাইরে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে স্যান্ডি একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল। হঠাত দরজা খোলার আওয়াজে চমক ভাঙে। ঘুরে দেখে বাবুল। মুখটা গম্ভীর।
- কিরে, কী হয়েছে?
- আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম।
- আরে খুলে বল না বালটা।
- আমরা আসার আগে নাকি বাবার আর জেঠুর আবার একপ্রস্থ ঝামেলা হয়েছে।
- কে বলল? কাকু?
- না, হরিকাকা
- হু ইজ হি?
- এ বাড়ির সব থেকে পুরনো কাজের লোক। প্র্যাক্টিক্যালি ছোটবেলায় ওর কোলেপিঠেই মানুষ আমি।
- হুম, কী হয়েছিল।
- তা বলতে পারল না। বাবার রুমে গিয়েছিলাম জিগ্যেশ করতে, তোকে আলাপ করাতে নিয়ে যাব কিনা। গিয়ে দেখি গুম মেরে বসে আছে। বাবার এ চেহারা আমি চিনি। খুব রেগে গেলে বা আপসেট হলে এরকম মুডে থাকে। সেসময় ঘাঁটানো মোটেই বুদ্ধিমানের নয়। তাই চুপচাপ বেরিয়ে আসছিলাম, তখনই হরিকাকার মুখোমুখি।
- ওকে। ছাড়। সব ঠিক হয়ে যাবে। হরিকাকার সঙ্গে কথা বলা যায়?
- বোস, ডাকছি।
বাবুল বের হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে আসে। পিছনে যে ঢুকলেন তাকে দেখেই স্যান্ডি আন্দাজ করল ইনিই হরিকাকা। পরণে বাড়ির লোকের মতনই পোষাক। ঠিক পরিচারকদের মতন নয়। অথচ হাতের ট্রেতে দুটো কাপ। তার মানে বাড়ির কাজের লোক হলেও বহু পুরনো। চেহারাটাও দেখার মতন। প্রায় ফুট ছয়েক লম্বা। দেখলেই বোঝা যায় কোনো একসময় শরীরচর্চা করতেন। এগিয়ে এসে ওদের দুজনের হাতে কাপ দুটো তুলে দেন।
- হরিকাকা, এ আমার বন্ধু স্যান্ডি। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
হরিকাকা একটু বিস্মিত হলেও কিছু না বলে স্যান্ডির দিকে জিজ্ঞাষু দৃষ্টিতে তাকান।
- আচ্ছা হরিকাকা আপনি কি আগে ব্যায়াম করতেন নাকি?
- ও, তোকে তো বলা হয়নি, হরিকাকা একসময় এলাকার নাম করা পালোয়ান ছিলেন। বলতে পারিস আমাদের ছোটবেলায় এ বাড়ির রক্ষাকর্তাও। এখনও অবশ্য তাই।
- শুধু আমি না। বড়োবাবুও লাঠি খেলা, তরোয়াল খেলা ছাড়াও আরো নানান কসরতে ওস্তাদ ছিলেন।
- আচ্ছা হরিকাকা, বাবুলের কাছে শুনছিলাম এ বাড়িতে নাকি দামী কোনো পাথর আছে?
বাবুল বিস্মিত হয়। হরিকাকা সাময়িক চমকে ওঠেন। তারপরেই বাবুলের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকান।
- বাবুলদাদা তোমার কিন্তু এইটা উচিত হয়নি। এ কথা বাইরের কাউকে বলে দিলা! বড়োবাবু জানতে পারলে ভীষণ রাগ করবা।
বাবুল হতবুদ্ধি হলেও চট করে সামলে নেয়।
- আরে ওকে বাইরের লোক ভেবো না। ও আমাদেরই একজন।
হরিকাকা চোখ সরু করে স্যান্ডিকে মেপে নেন একবার। তারপরেই মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দরজার পাল্লা দুটো বন্ধ করে এসে দাঁড়ান।
- কিছু মনে কোরো না, মা। তাইলে তোমার জানার হক আছে। বড়োবাবুরা দুই ভাই, ওনাদের বাবার কাছ থেকে একটি তামার তৈরি বাক্স উপহার পান। যেটার গায়ে বেশ কিছু দামী পাথর লাগানো। বাক্সের মধ্যে আছে ছটি বেশ বড় পাথর।
হাত দিয়ে মাপ বোঝানোর মুদ্রা করেন হরিকাকা।
- কী পাথর জানি না। তবে বড়োবাবুর কাছে শুনছি আজকের বাজারে দর নাকি কয়েক লক্ষ টাকা।
গলাটা আরও একটু আসতে করেন হরিকাকা।
- শুনছি বড়োবাবুর বাবা নাকি উইলে লিখে গ্যাছেন তাঁর দুই ছেলের কেউ এ পাথর বিক্রি করতে পারবা না। দুজনে যদি একসঙ্গে চান তবেই বিক্রি করতে পারবা।
একটু থেমে একবার বাবুলকে দেখে নেন।
- আমি যতদূর জানি এই পাথর বিক্রি করা নিয়েই একসময় ছোটোবাবুর সঙ্গে অবনিবনা হয় বড়োবাবুর। তারপর থেকেই দুই ভাই আলাদা। এতদিন পরে আবার দুজনকে একসঙ্গে দেখে বড়ই আনন্দ পাইছি মা।
মাঝে মাঝে হরিকাকার উচ্চারণে স্থানীয় টান।
- আজ কি এই পাথর নিয়েই আবার কনফ্লিক্ট? আই মিন ঝগড়া?
- ঠিক বলতে পারব না। তবে হতেও পারে। এ বড় অভিশপ্ত পাথর। বেচে দিলেই শান্তি ফেরে।
- আটকাচ্ছেটা কোথায়?
- দুই ভাইয়ের কেউ একজন বেচতে চান, অন্য ভাইয়ের আপত্তি। তবে কে কোন পক্ষে সেটা দু-ভাই ছাড়া কাক-পক্ষীতেও জানেনা।
হরিকাকা ইতিমধ্যে খালি হয়ে যাওয়া কাপদুটো নিয়ে বেরিয়ে যান। স্যান্ডি আবার ব্যালকনিতে আসে। পিছন পিছন বাবুলও। দুজনে দুটো সিগারেট ধরায়। বাবুলের বিস্ময় যেন এখনও কাটেনি।
- টেল মি সামথিং স্যান্ডি। দামী জিনিষটা যে পাথর আমিও জানতাম না। হাউ কুড ইউ নো!
- গেস ওয়ার্ক মাই ডিয়ার। বুলস আই হিট করেছি সেতো দেখলিই।
- তা না হয় হল। বাট হরিকাকা হঠাত্ তোর প্রশ্নের গড়গড় করে উত্তর দিল কেন? সামথিং ইজ ফিশি।
- কিচ্ছু ফিশি নয়। এর জন্য দায়ী তুই।
- আমি! হাউ কাম…!
- তুই যে ভাবে কন্সপায়ারিংলি বললি যে আমি বাড়ির লোক…
- সেতো যাতে তোর জিগ্যেশ করতে সুবিধে হয়। কিন্তু আমি বললাম আর উনিও…
- তার কারণ উনি ভেবেছেন আমি এ বাড়ির হবু বৌমা।
- যাঃ, কি বলছিস কি?
বিব্রত দেখায় বাবুলকে। স্যান্ডি হাসতে থাকে।
- বাট ওয়ান থিং ফর শ্যিওর। শুধু ফিজিক্যাল ওয়ার্ক-আউট নয় তোর হরিকাকা একসময় পড়াশোনাও করেছেন।
- হাইস্কুল অবধি পড়েছে তো…বাট হাই কুড ইউ গেস!
- এটা গেস নয়। ওনার কথা বলার ব্যালেন্স থেকেই ইট ওয়াজ ক্লিয়ার।
পুরনো বাড়ি হলেও একতলার বিশাল ড্রইংরুম আধুনিক ভাবে সুসজ্জিত। একমাত্র পুরনো জিনিষ, দেওয়ালে আটকানো গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা। তবে সেটারও অ্যান্টিক ভ্যাল্যু আছে। এবং ঘড়িটা এখনও সঠিক সময় দিচ্ছে। একটু আগেই জানান দিয়েছে এখন বাজে সন্ধ্যে সাতটা। এই রকম ঘড়ির কথা বইয়ে পড়লেও এটাই স্যান্ডির প্রথম চাক্ষুশ অভিজ্ঞতা। বাবুলের বাবা এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। হাসিমুখে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। বাবুলের জেঠু এখনও অনুপস্থিত। কোথাও বেরিয়ে ছিলেন। খানিক আগেই ফিরেছেন। সকলের কাছে মার্জনা চেয়ে ভিতরে গিয়েছেন চেঞ্জ করতে। হাতে একটা বড় ব্যাগে কিছু নিয়ে এলেন। অতিথিদের জন্য সারপ্রাইজ মেনু। বাবুলের বাবা, জেঠু দুজনেই সুপুরুষ। দীর্ঘদেহী এবং বলশালী। ডার্ক ব্রাউন স্যুটে বাবুলের বাবাকে পাক্কা সাহেব লাগছে। অতিথিরা প্রায় সবাই এসে গিয়েছেন। হরিকাকা নিজে গেটে দাঁড়িয়ে অভ্যাগতদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। কেউ এলেই সঙ্গে করে ঘরে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন। গেটে অবশ্য সর্বক্ষণের প্রহরার ব্যবস্থাও আছে। ড্রইংরুমের একদিকে মেকশিফ্ট বার তৈরি করা হয়েছে। তিন রকমের হার্ড এবং কিছু সফ্ট ড্রিংকস-এর ব্যবস্থা আছে। স্যান্ডি একটা স্কচ অন দ্য রকস নিয়ে ঘরের সবথেকে দূরবর্তী চেয়ারে একা বসে। আসলে অতিথিদের ভাল করে অবজার্ভ করাই ওর লক্ষ্য।
ঘরের সামনের দিকে সোফা সেটটায় বসে চারজন। হাতে হাতে রকমারী পানীয়ের গ্লাস। কেউ এলেই বাবুল এসে তাদের পরিচয় জানিয়ে যাচ্ছে। সোফায় বসে কালো মতন খর্বকায় এক প্রৌঢ়। নাম সুব্রত গাঙ্গুলি। আলিপুরদুয়ারের বিখ্যাত ক্রিমিন্যাল ল-ইয়ার। সঙ্গে তাঁর সহধর্মিনী। বেশ মা, মা দেখতে। আর আছেন তাঁদের বিদূষী কন্যা সংযুক্তা। বাবুলের পছন্দ আছে। হ্যাঁ, এই তথ্যটিও বাবুলেরই সরবরাহ করা। বিশেষত বাবুলের বিগত কয়েক বছর জেঠুর বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসার প্রধান আকর্ষণ ইনিই। তবে এ বিয়েতে সুব্রতবাবুর মত নেই। কেন? বলা মুশকিল। অমতের কথা বাবুল না জানালেও স্যান্ডি বুঝতে পারত। কারণ যে ভাবে উনি ওনার কন্যা আর বাবুল, উভয়কে চোখে চোখে রাখছেন তাতে ওনার অমতটি যথেষ্ট প্রকট। কন্যাও অবশ্য বাবুলকে বিশেষ নম্বর দিচ্ছে না। বাবুলের দাবী সত্যি হলে বলতে হয়, মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। পার্টিতে ছন্দপতন হতে দিতে চায় না।
বাবুলের বাবা যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন তিনি ওনারই সমবয়সী। কোনো এক সময় নাকি ক্লাসমেট ছিলেন ওনারা। ডাঃ সৌম্যকান্তি ত্রিপাঠি। নামের সঙ্গে চেহারার যথেষ্ট মিল। গোটা উত্তরবঙ্গে ওনার চেয়ে বড় শল্যচিকিত্সক নাকি আর নেই। মজার কথা উনি যে স্যুটটি পড়েছেন সেটিও হবহু বাবুলের বাবারটির যমজ। এসেছেন আলিপুরদুয়ারের এস পি। সস্ত্রীক। মিস্টার কে ভুটিয়া। এনার সঙ্গে স্যান্ডির আলাপ নেই। সম্ভবত সম্প্রতি বদলি হয়ে এসেছেন। চেহারা দেখে আন্দাজ করা যেতেই পারে, ডায়নামিক অফিসার। অসম্ভব ভাল বাঙলা বলছেন। ওনার স্ত্রী বাঙালি। রত্না। সুন্দরী। একহারা। দুজনকে মানিয়েছে ভাল। আর আছেন মিস্টার রবি ভগত্। উত্তরবঙ্গের মুখ্য বনপাল। বাবুলের জেঠুর বিশেষ বন্ধু। যদিও ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের বেশি নয়। তবে বেশ জমাটি মানুষ। ওনাকে কেন্দ্র করেই পার্টি প্রাণ পেতে শুরু করেছে। এই সময়ে হরিকাকা যাকে নিয়ে ঢুকলেন তাকে দেখেই স্যান্ডি তরাক করে উঠে দাঁড়ায়। তিনি আলুপুরদুয়ারের জেলাশাসক অভিরূপ দত্ত। মিস্টার দত্তও স্যান্ডিকে দেখতে পেয়েছেন।
- হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ মিস মুখার্জি। হাউ অন দ্য আর্থ ইউ আর হেয়ার, অ্যাট দেবীপুর?
সহাস্যে করমর্দন করেন ডি এম সাহেব।
- আরে আমিও ভাবিনি আপনার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে যাবে।
মিস্টার দত্তর সঙ্গে স্যান্ডির আলাপ বক্সায় মুখ্যমন্ত্রীর সফরের সময় (গল্প- ডিও-ডোর-এন্ড)।
- আশা করা যায় কোনো অপরাধের তদন্তে নয়, ম্যাডাম!
ডি এম-এর সরস মন্তব্যে ঘরে পিন পড়া নৈশঃব্দ। সব চোখ স্যান্ডির দিকে। স্যান্ডি বিব্রত হলেও সামলে নেয় দ্রুত।
- না না। জাস্ট বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে।
- এনাকে তো টিভিতে খবর পড়তে দেখি।
এবারের বিস্মিত বক্তা, সংযুক্তা।
- ঠিকই দেখেন, ম্যাডাম। বাট ওনার রহস্যোন্মচনের ক্ষমতাও দারুণ। সেবার সি এম ভিজিটের সময় আমাদের প্রেস্টিজ সেভ করেছিলেন স্যন্দিকা ম্যাডাম।
সগর্বে দত্ত উপস্থিত সকলকে জানান। মিস্টার ভুটিয়া এগিয়ে এসে আলাপ করেন। ঠিক সেই সময় বাবুলের জেঠু প্রবেশ করায় আলোচনাটা ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! ডি এম, বাবুলের জেঠু দুজনেই স্যুট পরিহিত, এবং সেম কালার! অর্থাত্ বাবুলের বাবার মতন। এখানে কি অলিখিত কোনো ড্রেসকোড ছিল নাকি! হেসে ফেলে স্যান্ডি। ফিরে যায় নিজের চেয়ারে। কেউ হালকা মিউজিক চালিয়ে দেন। পার্টি আবার পার্টি হয়ে ওঠে। ছোট ছোট দলে আড্ডা জমে ওঠে। বাবুল টুক করে এসে এক চুমুকে একটা ড্রিঙ্ক শেষ করে চলে যায় অতিথি আপ্যায়নে।
ক্রমে ডিনারের সময় হয়। সংলগ্ন ডাইনিং হলে সকলে একত্রিত হন ডিনারের জন্য। তখনই হঠাত্ মিস্টার ভগত্ এর মুঠোফোন বেজে ওঠে। খানিক্ষণ কিছু শোনেন। জবাবে খালি কয়েকটা ‘ওকে’ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। তারপর উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন উনি।
- সরি, একটা দুঃসংবাদ আছে। এখান থেকে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার রাস্তায় হাতির একটা বড় দল ঘোরাফেরা করছে। আই থিঙ্ক ইট উইল বি নট সেফ ফর আস….
ক্রমবর্ধমান গুঞ্জনে চাপা পড়ে যায় ওনার কথা। মুহুর্তে বাবুলের জেঠু যোগ্য হোস্টের ভুমিকায়।
- আমার মনে হয় রিস্ক নেওয়ার কোনো দরকার নেই। এখানে যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে। আজকের রাতটা এই গরীবখানাতেই কাটিয়ে যান সবাই।
হরিকাকাকে ডেকে উনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। প্রত্যেকেই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন নিজেদের সেলফোনে। স্বাভাবিক। এই অকল্পনীয় পরিস্থিতির খবর প্রয়োজনীয় জায়গায় পৌঁছনো দরকার।
ডিনার শেষ। আবার ড্রইংরুম। ছোট ছোট দল। আর ফিসফাস আড্ডা। স্যান্ডি খেয়াল করে তিনজনের অনুপস্থিতি। সংযুক্তা, বাবুল আর বাবুলের বাবা। বাবুলের বাবার ব্যাপারটা নিয়ে ও মাথা ঘামায় না। পুরো পার্টির সময়ে উনি মাঝে মাঝেই গায়েব হয়ে যাচ্ছিলেন। বাবুলকে জিগ্যেশ করে স্যান্ডি জানতে পারে উনি রেগুলার স্মোকার। অভ্যাগত এবং দাদার সামনে স্মোক করবেন না বলে পিছন দিকের একটি ঘরে চলে যাচ্ছেন মাঝে মাঝেই। খাওয়া দাওয়ার পর ওনার অনুপস্থিতি তাই অস্বাভাবিক নয়। প্রথম দুজনের অনুপস্থিতি আরও একজন খেয়াল করেছেন। তিনি সুব্রতবাবু। উঠে তিনিও বাড়ির পিছন দিকে রওনা দিলেন। স্যান্ডি হাসে। তারপর নিজেও দোতলায় যায়। এই ঠান্ডায় একটা সিগারেট হলে মন্দ হয় না। ঠান্ডার জন্য ব্যালকনিতে না গিয়ে ঘরের জানলা অল্প ফাঁক করে সিগারেট ধরায় ও। দৃষ্টি বাইরের অন্ধকারে। তবে সম্ভবত পূর্ণিমা দু-একদিনের মধ্যেই ছিল অথবা আসছে। তাই জ্যোত্স্নায় বেশ একটা মায়াময়তা। সিগারটটা যখন প্রায় শেষ হঠাত্ একটা চিত্কার। সিগারেটটা ফেলে দ্রুত নিচে আসে স্যান্ডি। সকলেই তখন বাড়ির পিছনদিকে। যে দরজাটা বাগানে উন্মুক্ত হয়, সেখানেই ভিড়। সুব্রতবাবু হাঁফাচ্ছেন। মুখ দেখেই মনে হচ্ছে বেশ ঘাবড়েছেন। বাগানে হাজির দলের মধ্যে কিন্তু সংযুক্তাও আছে। বাবুলের জেঠুই সুব্রতবাবুকে ধরে ভিতরে নিয়ে আসেন।
- কী হয়েছে? কী দেখে ভয় পেলেন?
সুব্রতবাবু খানিকটা সামলে নিয়েছেন। ইশারায় মহিলাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন। মিস্টার ভগত্ দ্রুত পরিস্থিতি উপলব্ধি করে মহিলাদের নিয়ে বসার ঘরের দিকে চলে গেলেন।
- বাগানে ডেডবডি!
প্রায় ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলেন সুব্রতবাবু। স্যান্ডি এতক্ষণ ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। তাই ওকে কেউ লক্ষ্য করেনি। এবার এগিয়ে আসে। পেশাগত ক্ষিপ্রতাতেই এস পি সাহেব ইশারা করেন সুব্রতবাবুকে বাগানে নিয়ে যেতে। ওদের দুজনের সঙ্গে ডাঃ ত্রিপাঠি, জেঠু, ডি এম এবং স্যান্ডিও বাগানে প্রবেশ করে। বিশাল বাগানের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছয় ওরা। পিছন দিকের পাঁচিলের কাছাকাছি। একটা গাছের নিচে ইঙ্গিত করেন সুব্রতবাবু। স্যুট পরিহিত এক ব্যাক্তি মাটির দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন।
- ডাঃ ত্রিপাঠি প্লিজ দেখুন যদি এখনো বেঁচে থাকেন।
মিঃ ভুটিয়ার অনুরোধ। বাগানে আলো বলতে চাঁদের আলো। ডাঃ ত্রিপাঠি হাতের নাড়ি দেখেন প্রথমে। তারপরেই একটা চাপা শব্দ বের হয় তাঁর মুখ দিয়ে। পড়ে থাকা ব্যাক্তির কাঁধের কাছে ইঙ্গিত করেন উনি। সকলেই ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা চালান। মাটিতে কালচে জলীয় পদার্থ। স্যান্ডি মোবাইলের টর্চ জ্বালে। দেখা যায় চাপ চাপ রক্ত।
- আরে তাইতো মোবাইল তো সকলের কাছেই আছে!
ডি এম যেন একটু বিব্রত। আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় এস পি সাহেবের মতন, এ ধরণের কেস হ্যান্ডেল করায় পোক্ত মানুষও সাময়িক বিভ্রান্তিতে। তার উপর পার্টির প্রভাব। স্বাভাবিক, খুবই স্বাভাবিক। মনে মনে বলে স্যান্ডি। প্র্যাক্টিক্যালি ওর নিজেরও এতক্ষণে মনে পড়ল মোবাইলের কথা।
ডাঃ ত্রিপাঠি আর মিঃ ভুটিয়া দেহটিকে সোজা করতে গিয়ে আবার বিস্ময়ের মুখোমুখি। ধড় মুন্ডু একদম আলাদা। মুখের উপর আলো ফেলা হল। স্যান্ডি বাদে উপস্থিত সকলেই চমকে উঠলেন।
- আরে এতো সুদখোর চক্কোত্তি!
সুব্রতবাবুর গলায় বিস্ময়। আসলে আলিপুরদুয়ারের সকলেই সুগত চক্রবর্তিকে চেনে। সুদের কারবার করেন বলে লোকে সুদখোর চক্কোত্তি বলে ডাকে।
- মিস্টার চৌধুরী, ইনিও কি ইনভাইটেড ছিলন নাকি?
মিঃ ভুটিয়ার সরাসরি প্রশ্ন জেঠুকে।
- আমার কি মাথা খারাপ যে একে আমন্ত্রণ জানাব!
জেঠু সপাটে অস্বীকার করেন।
- তাছাড়া এর সঙ্গে তোমার কি একটা গোলমাল হয়েছিল না একবার?
যেন নিজের মনেই প্রশ্ন করেন সুব্রতবাবু। তবে সে বিষয়ে কেউ গা করে না। এবার স্যান্ডি সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
- আমার মনে হয় ইমিডিয়েটলি কয়েকটা কাজ করা উচিত।
স্যান্ডির গলায় সকলেই ওর দিকে তাকায়।
- আপাতত ডেডবডি এখানেই থাক। কেউ একজন মহিলাদের কাছে খবরটা দিন, ইন আ ম্যানার, যাতে খুব উত্তেজনার কারণ না ঘটে। আই থিঙ্ক মিস্টার ভগত্ ইজ দ্য বেস্ট পার্সন। আর একবার দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলা দরকার, তবে ও যেন গেট থেকে এখনই না সরে।
- ঠিক বলেছো, মা। আমি যাচ্ছি ভগত্কে আর দারোয়ানকে বলতে।
দ্রুত বাগান ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন জেঠু। স্যান্ডি টর্চের আলোয় আশপাশটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। কিছুটা দূরে বেশ কিছু গাছের ডালের টুকরো পরে আছে ইতিউতি। একটা টুকরো হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখে স্যান্ডি।
- ডাঃ ত্রিপাঠি, হোয়াট কাইন্ড অফ ওয়েপন কুড হ্যাভ ডান দিস?
এস পি সাহেবের প্রশ্নে সব চোখ ডাক্তারের দিকে। উনি তখন খুঁটিয়ে গলার কাছটা পরীক্ষা করছিলেন।
- কোনো সাধারন ছুঁরি বা অস্ত্র নয়। সামথিং লার্জ অ্যান্ড হেভি।
- যেমন বড় তরোয়াল গোছের!
মিঃ দত্ত জানতে চান এবার।
- সম্ভবত তাই, কিন্তু…
- রাইট, এরকম অস্ত্র এখানে আসবে কোথা থেকে?
অবাক এস পি-র প্রশ্ন।
- হাতির জন্য তো সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কাল সকালের আগে অ্যাম্বুলেন্স, পোলিস কিছুই আসতে পারবে না।
চিন্তিত স্যান্ডির মন্তব্য।
- লেট আস ডু ওয়ান থিং। বডি আপাতত কোনো একটা ঘরে রাখার ব্যবস্থা করা যাক। কেউ প্লিজ দু একজন হেল্পিং হ্যান্ড ডেকে আনবেন?
এস পি সাহেবের অনুরোধে একটা নির্দেশের আভাষ ছিল। সুব্রতবাবু দ্রুত রওনা দিলেন।
- আমিও দেখছি।
পিছু নিলেন ডি এম সাহেব।
- নাও দ্য কোয়েশেচন ইজ হাউ দিস ম্যান হ্যাজ এন্টার্ড দ্য হাউজ।
উঁচু পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই প্রশ্ন করে স্যান্ডি।
- রাইট ইউ আর, ম্যাডাম। দারোয়ানই জবাব দিতে পারবে।
এস পি-ও চিন্তিত।
- পাঁচিল কি টপকানো সম্ভব?
এবার প্রশ্ন ডাক্তারের। স্যান্ডি নেতিবাচক ঘাড় নাড়ে।
- অসম্ভব নয়। তবে ইমপ্র্যাক্টিক্যাল। তাছাড়া নিট প্রেসড স্যুট এবং তার উপর কোনো দাগ না থাকা সাজেস্ট করছে ইনি পাঁচিল টপকাননি।
- তাহলে দারোয়ানই ঘুষ খেয়ে…
- ইম্পসিবল মিস্টার ভুটিয়া। আপনি বোধহয় খেয়াল করেননি বাড়ির প্ল্যানিংটা বিচিত্র। গেট দিয়ে ঢুকলেও বাড়ির যে কোনো প্রান্তে বা বাগানে যেতে হলে ড্রইংরুম ক্রশ করতেই হবে। আমরা কিন্তু সেখানেই ছিলাম। তাছাড়া ডি এম সাহেব আসা অবধি হরিকাকাও গেটের সামনে ছিলেন। তারও আগে চক্রবর্তির বাড়িতে ঢুকে লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এত চাকর-বাকরের মধ্যে ধরা পড়ে যেত।
এস পি কে থামিয়ে দিয়েই বলে স্যান্ডি। খুবই চিন্তিত লাগছে ওকে। এস পি-ও ওর সঙ্গে একমত হন। বস্তুত ডাক্তারও সহমত হয়ে ঘাড় নাড়েন।
সকলেই এখন আবার ড্রইংরুমে। বাবুলও হাজির। গল্পের ছলেই এস পি শুরু করলেন।
- বাই দ্য ওয়ে মিস্টার গাঙ্গুলি আপনি এই ঠান্ডায় বাগানে কী করছিলেন?
- সরি টু সে ইউ এস পি সাহেব দিজ ইজ নট এনাফ এভিডেন্স টু কনভিক্ট মি।
সুব্রতবাবু বেশ চ্যালেঞ্জের সুরেই বলে ওঠেন। স্যান্ডি হেসে ফেলে।
- আরে সুব্রতবাবু রাগ করছেন কেন? মিঃ ভুটিয়া কিন্তু তা মিন করতে চাননি। ওকে, ডু ওয়ান থিং আপনি এখান থেকে বাগানে যাওয়া এবং বডি দেখতে পাওয়া অবধি কী কী হয়েছে প্লিজ বলুন।
- আমি বাগানে গিয়েছিলাম, খাওয়ার পর একটু হাঁটব বলে। সুন্দর চাঁদের আলো। যখন পায়চারি করছি তখনই দেখি একটা ছায়ামূর্তি বাগান সংলগ্ন বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে এগোচ্ছে। তারপরই বাড়িতে ঢুকে যায়। অল্প আলোতেও আমি চিনতে পারি তাকে। তখনই হঠাত্ চোখে পড়ে বাগানে গাছের নিচে কে পড়ে আছে।
- কাকে দেখেছিলেন আপনি বাড়িতে ঢুকতে?
এবার এস পি-র গলা দৃঢ় হয়।
- তমোঘ্নকে।
বাবুল যেন চমকে ওঠে। স্যান্ডি-র ঠোঁঠে মৃদু হাসি। তবে কিছু বলে না।
- সেকি, আপনি বাগানে কী করছিলেন?
এস পি-র প্রশ্ন।
- জাস্ট এমনিই...
- কী ব্যাপার বলুনতো, সকলেই এই ঠান্ডায় বাগানের পথে…
এস পি-র গলায় শ্লেষ।
- তাহলে তুমি ওরকম ভাবে লুকিয়ে ঢুকছিলে কেন?
সুব্রতবাবু যেন আদালতে আসামীকে চেপে ধরতে চান।
- না মানে, আসলে…
- মানেটা আমি বলছি বাপি।
সংযুক্তার তীব্র কণ্ঠে সবাই হতচকিত হয়ে যায়।
- ছি, ছি, ছি, বাপি, তুমি ওকে পছন্দ করো না বলে ওকে ফাঁসি কাঠের দিকে ঠেলে দেবে!
সুব্রতবাবু লজ্জায় অধোবদন। বাবুল কিছু বলতে যায়। সংযুক্তা ওকে বলার সুযোগ না দিয়েই বলতে থাকে।
- বাবুল নেহাতই একজন সজ্জন ভদ্রলোক। না হলে এরপরেও চুপ করে থাকত না। আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য ও নিজে ফাঁসিকাঠের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আসলে ও একা না, আমিও ছিলাম বাগানে। হ্যাঁ, ওকে আমি ভালবাসি। সে কারণেই ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। আর বাপি, তুমি মোটেই পায়চারি করতে যাওনি, ঘরে আমরা দুজন নেই দেখে আমাদের ফলো করেছিলে।
ঘরে পিন পড়লেও শব্দ হবে। সুব্রতবাবুর অবস্থা যেন জোঁকের মুখে নুন।
- কিন্তু কাকু কি বাঁশের চেয়েও লম্বা সিগারেট খাচ্ছেন নাকি!
স্যান্ডির মন্তব্যে হঠাত্ সকলে যেন সম্বিত ফিরে পায়। তাই তো তরুণবাবুর এখনো দেখা নেই।
- হরি একবার দেখে এসো তো।
জেঠুর নির্দেশ। চাপাস্বরে গুঞ্জন শুরু হয় আবার ঘরে।
- সব থেকে ইম্পর্ট্যান্ট প্রশ্ন মার্ডার ওয়েপনটা কী? জেঠু বাড়িতে কি কোনো পুরনো দিনের তরোয়াল আছে নাকি?
স্যান্ডির প্রশ্নে অনেকেই অবাক হন। তপনবাবুও।
- না তো মা। হঠাত্ এ প্রশ্ন?
স্যান্ডি কিছু না বলে এস পি আর ডাক্তারের দিকে তাকায়। মুখে মৃদু হাসি। কিন্তু ওরা দুজন বিস্ময়ের শেষ সীমায়।
- জেঠু আপনি তো কালী ভক্ত, বাড়িতে কি পুজো টুজোও হয়?
- কিন্তু তুমি কী করে….
বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে যায় তপনবাবুর।
- আধুনিক সজ্জিত ড্রইংরুমে অ্যান্টিক গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক বেমানান লাগলেও, আমাদের সমাজে, টাটকা মালা পরানো কালী ঠাকুরের ছবি কিন্তু বেমানান নয়।
স্যান্ডির দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই উল্টো দিকের দেওয়য়ালে টাঙানো মা কালীর ছবিটার দিকে তাকান। সকলের দৃষ্টিতেই বিস্ময় এবং শ্রদ্ধা।
- আই টোল্ড ইউ, শি ইজ এক্সট্রিমলি শার্প।
মিঃ দত্ত-র চোখে প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত। কথাটা তিনি ফিসফিসিয়ে এস পি-র উদ্দেশে বলেন।
- বাট আই ফেইল টু আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়্যার ইজ শি লিডিং আস….
- বলছি মিঃ ভুটিয়া। জেঠু, যা জিগ্যেশ করলাম।
- হ্যাঁ, মা। পুজো হয়। একটাই পুজো হয়। কালী পুজো। এ বাড়িতেই। সাধ্য অনুযায়ী ধুমধাম করি।
- বলি হয়?
- এক কালে মহিষ বলি হত, এখন পাঁঠা বলি হয়।
- কে দেন বলি?
- কেন, আমি! বয়স হলেও মায়ের তৃষ্ণা মেটাতে এই কাজটা বরাবর আমিই করি।
- না, ছোটবাবু বাড়ির কোত্থাও নেই।
হরিকাকার এই সংবাদে সকলেই বিচলিত হয়ে ওঠেন। স্যান্ডি তখন নিজের ফর্মে।
- হরিকাকা, একটু দারোয়ানকে ডাকবেন, প্লিজ!
বিস্মিত হরি চলে যান গেটের দিকে। স্যান্ডি আবার ফিরে যায় আগের প্রসঙ্গে।
- জেঠু বলি দেওয়ার যে যন্ত্র, কী যেন বলে?
স্যান্ডির বলার ধরনে অনেকেই হেসে ফেলেন।
- খড়গ। চলতি কথায় খাঁড়া।
- হ্যাঁ, খাঁড়া। সেটা কোথায় থাকে?
- কেন? ঠাকুর ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো থাকে।
দারোয়ানকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন হরি।
- হরিকাকা, একবার ঠাকুর ঘরে দেখুন তো খাঁড়াটা আছে কিনা?
বিস্মিত হরি একবার তপনের দিকে তাকান তারপর আবার বাড়ির ভিতরে চলে যান।
- আপনি ছোটবাবুকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছেন?
- না, দিদিমণি।
- গেট ছেড়ে কবার গেছিলেন।
- মা কালীর দিব্যি দিদিমণি, সন্ধ্যে ছটায় ডিউটি ধরার পর একবারও কোত্থাও যাইনি।
- এই ঠান্ডায় বাথরুমেও না?
- একবারই গেছিলাম, তাও হরিদাদা যখন গেটে ছিল। তখনও এই বাবু আসেননি।
দারোয়ান ডি এম-এর দিকে ইঙ্গিত করে।
- সর্বনাশ হয়ে গ্যাছে বড়বাবু। মায়ের আশীর্বাদী খাঁড়াটা ঘরে নেই।
- হোপ, নাও ইউ গট ইয়োর মার্ডার ওয়েপন।
স্যান্ডি হেসে এস পি-র দিকে তাকায়। ঘরে যেন ছোটখাটো ঝড় বয়ে গিয়েছে। বিশেষত হরি এসে খাঁড়া হারানোর খবর দেওয়ার পর। সব শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টি তখন স্যান্ডির দিকে।
- বাট দ্য কোয়েশ্চেন ইজ হোয়্যার ইজ কাকু?
আনমনেই যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে চিন্তিত স্যান্ডি। সকলের মুখ দেখে বোঝা যায়, সবার মনেই এক প্রশ্ন। প্রাচীন ঘড়ি জানান দেয় রাত বারোটা বাজে। তখনকার মতন কারোরই আর প্রায় কিছুই করার নেই। জেঠুর অনুরোধে যে যার জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দিকে রওনা দেন রাতটুকু কাটিয়ে দিতে। স্যান্ডিও নিজের রুমে ফেরে।
বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে কাত হয়ে বসে ও। পরপর গোটা দুয়েক ফোন করে। ওদের আলিুপরদুয়ারের রিপোর্টার আর ক্যামেরাম্যানকে। এদিকে মাথায় একরাশ প্রশ্ন ঘুরে চলেছে।
১) সুগত চক্রবর্তী বাগানে গেল কখন আর কী ভাবে?
২) তরুণবাবু খাওয়ার পর ভ্যানিশ করে গেলেন?
৩) দারোয়ান দেখতে পেল না কেন?
৪) যাওয়ার আগে নিজের ছেলেকেও কেন বলে গেলেন না?
৫) মার্ডার ঠিক কখন হল?
৬) মারা যাওয়ার আগে ভিক্টিম চিত্কার করল না কেন?
৭) মার্ডারের কারণ কী?
৮) হু ইজ দ্য মার্ডারার?
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে স্যান্ডি।
আলো ফুটেছে কিছুক্ষণ হল। ভোর ছ’টা। বাগানের সিমেন্ট নির্মিত বেঞ্চে তিনজন বসে। ডি এম, এস পি আর ডাক্তার ত্রিপাঠি।
- এরকম আজব হত্যা রহস্যের কথা আগে কখনও শুনিনি।
ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলে ওঠেন মিস্টার ভুটিয়া।
- খাঁড়া দিয়ে একটা মানুষকে ওভাবে এক কোপে কাটা যায়!
বিস্ময় মাখানো উক্তি ডাঃ ত্রিপাঠির।
- প্রশ্ন তো আরও আছে ডাঃ ত্রিপাঠি, কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
সায় দেন এস পি।
- ডেফিনিটলি স্যন্দিকা ম্যাডাম কিছু একটা আঁচ করেছেন।
এতক্ষণে মুখ খোলেন ডি এম।
- বাট স্যার, আই হ্যাভ ফিউ কোয়েশ্চেনস। আপনার স্যন্দিকা ম্যাডামকে আগে সেইগুলো জাস্টিফাই করতে হবে। তবেই ওনার কোনো থিওরি আমি শুনব।
ম্লান হেসে বলেন মিঃ ভুটিয়া।
- যেমন?
কৌতুহলি প্রশ্ন ছিটকে বের হয় একই সঙ্গে ডি এম এবং ডাঃ ত্রিপাঠির গলা থেকে।
- যেমন? অনেক ইজি ওয়ে ছিল, হোয়াই খাঁড়া। হেভি, ধরা পড়ে যাওয়ার চান্স।
- রাইট, আর?
চিন্তিত প্রশ্ন ডি এম-এর।
- ভিক্টিম কেন চিত্কার করল না?
- এটা ঠিক বলেছেন। অত লম্বা মানুষ তো আর হাঁড়িকাঠে মাথা দিয়ে ছিল না, যে এলাম আর ঝপাং করে কেটে ফেললাম।
চিন্তিত ডাঃ ত্রিপাঠির মন্তব্য।
- চক্রবর্তি কী করে বাগানে এল?
- ক্লু লেস।
- আমিও তাই।
এক কথায় একমত হন ডি এম এবং ডাক্তার।
- লাস্টলি, তরুণবাবু কী ভাবে ভ্যানিশ করে গেলেন?
- কিন্তু প্রশ্ন যে আরও আছে মিস্টার ভুটিয়া।
নারী কণ্ঠ শুনে তিনজনেই ঘুরে দেখেন, স্যান্ডি দাঁড়িয়ে। মুখ অসম্ভব গম্ভীর।
- আপনার পোলিস টিম আর ফোটোগ্রাফার স্টার্ট করেছে আলিপুরদুয়ার থেকে?
- ইয়েস ম্যাম, দে আর এক্সপেক্টেড উইদিন হাফ অ্যান আওয়ার।
- কিন্তু আর কী প্রশ্ন আছে বলছিলেন?
এস পি-র উত্তরের পর ডি এম-এর প্রশ্ন।
- খাঁড়াটা পাওয়া গ্যাছে। গেট থেকে বাড়ির বাউন্ডারি ওয়াল বরাবর খানিকটা এগিয়ে রাস্তার ধারে। আর পিছনের নদী থেকে উদ্ধার হয়েছে আর একটা কাটা মুন্ডু। টাটকা। অর্থাত্ চপড উইদিন লাস্ট টুয়েলভ আওয়ার্স।
স্যান্ডি গম্ভীর মুখে সকলের প্রতিক্রিয়া দেখতে থাকে। হঠাত্ লাফিয়ে ওঠেন এস পি।
- আই গট ইট। তরুণবাবু হ্যাজ বিকাম ম্যানিয়াক। সার্কমস্টেন্সিয়াল এভিডেন্স বলছে হি ইজ ইন আ কিলিং স্প্রি।
- মেনে নেব। তার আগে দুটো প্রশ্ন আছে।
স্যান্ডির শীতল কণ্ঠে এস পি-র তত্পরতা ভ্যানিশ।
- লাইক ইয়োর লাস্ট কোয়েশ্চেন, কাকু খাঁড়া নিয়ে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে বাইরে গেলেন কখন?
সবাই চুপ। প্রত্যেকেই চিন্তান্বিত।
- এবং ফাইনালি কেউ খাঁড়া দিয়ে কি নিজের মুন্ডু ধর থেকে আলাদা করতে পারে?
- হোয়াট?
বুলেটের মতন প্রশ্ন ভেসে আসে একসঙ্গে তিনটে গলা থেকে।
ইংরেজিতে একেই বোধহয় বলে গ্লুমি ফেসেস। সকালে একতলার বসার ঘরের চেহারাগুলো দেখে স্যান্ডির তাই মনে হল। বাবুল কোণে বসে একা ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। সংযুক্তা পাশে বসে সান্তনা দেবার চেষ্টা করছে। জেঠু দৃশ্যতই ভেঙে পড়েছেন। মুখ চুন হরিকাকারও। তবে সবথেকে হৃদয়বিদারক অবস্থা ডাক্তার ত্রিপাঠির। বাল্যবন্ধুর এহেন মৃত্যুতে তিনি প্রায় মাস্তুল ভাঙা জাহাজ। এই সময় ফোন বেজে ওঠে স্যান্ডির। ও কথা বলতে বলতে বাইরে চলে যায়। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আবার ফিরে আসে। চোখমুখ উজ্বল।
- মিঃ ভুটিয়া, আপনার টিম কতদূর?
- আর ফিফটিন মিনিটস ম্যাডাম। বুঝেছি, আপনারা সকলেই এখান থেকে বেরোতে চাইছেন। বাট মিস্ট্রি সলভ না হওয়া অবধি কেউ আলিপুরদুয়ার ছেড়ে যেতে পারবেন না। ইয়েস, স্যন্দিকা ম্যাডাম, আপনিও।
- ওনাকে বলবেন না। শি ইজ ক্লোজ টু সি এম।
প্রায় ফিসফিসিয়ে এস পি-কে সতর্ক করেন ডি এম।
- তার আর দরকার পড়বে না মিঃ দত্ত। ‘কজ দ্য মিস্ট্রি ইজ সলভ্ড।
মৃদু হেসে ডি এম-কে জানায় স্যান্ডি। সকলের বিস্মিত দৃষ্টি তখন ওর দিকে। এমনকি বাবুল, তপনবাবু এবং ডাক্তারও যেন সাময়িক শোক ভুলেছেন।
- বাট বিফোর দ্যট, ইউ নিড টু আনসার…
- আই নো। ইউ মে শ্যুট ইয়োর কোয়েশ্চেন্স।
- নম্বর ওয়ান। খাঁড়ার মতন অমন একটা ভারী এবং জবরজং ওয়েপন কেন মার্ডারার বাছল? আ বুলেট অর নাইফ কাজটাকে আরও ইজি করত?
- বিকজ, হেভি সোর্ড ছাড়া একমাত্র খাঁড়াই পারে, এক কোপে গলা কাটতে। আসলে মার্ডারার প্ল্যানটা জব্বর করেছিল। স্পেশালি কালীপুজো গ্যাছে দুমাসও হয়নি। তার মানে বলি দেওয়ার জন্য ধার করানো হয়েছিল। কারণ এক কোপে বলির জন্তুর গলা না কাটলে সেটা অমঙ্গল ডেকে আনে বলেই হিন্দুদের বিশ্বাস। তাইতো জেঠু?
তপনবাবু মাথা নেড়ে সায় দেন।
- বাট ম্যাডাম সোর্ড নয় কেন?
এবার প্রশ্ন ডি এম-এর।
- কারণ সেরকম কোনো সোর্ড থাকলে সেটা অ্যান্টিক পিস হত। তাহলে ডেফিনিটলি ডিসপ্লেতে থাকত। লাইক আদার অ্যান্টিক পিসেস। আর আপনাদের অনেকেই এ বাড়িতে আগেও এসেছেন। তাই কাল যখন জেঠু বললেন ওরকম কিছু নেই, তখন কেউ না কেউ প্রতিবাদ করতেন।
- বাট ভিক্টিম কেন চ্যাঁচালো না?
- তার কারণ মার্ডারার প্রথমত তার চেনা ছিল, সেকেন্ডলি মার্ডারারের হাতে খাঁড়া দেখে সে কিছু সাসপেক্ট করেনি। নিশ্চয় তেমন রিজন ছিল। যার প্রমাণ, গাছের ছোট কাটা ডালগুলো। যেগুলো পড়ে ছিল গাছের থেকে খানিক দূরে। ফাঁকা জায়গায়। আপনিও দেখেছেন। পরে ডিটেইলস বলছি। নেক্সট কোয়েশ্চেন প্লিজ।
- চক্রবর্তি কী করে বাগানে এলো?
- আসেনি তো!
- কি অ্যাবসার্ড কথা বলছেন স্যান্দিকা ম্যাডাম?
এবার চিত্কার করে ওঠেন ডি এম।
- মানে আপনি বলছেন চক্রবর্তীর বাগানে আসাটা মিথ্যে?
চ্যালেঞ্জিং সুর এস পি-র গলায়। ঠোঁঠে বাঁকা হাসি।
- না, পার্শিয়ালি সত্যি।
- কী আবোল-তাবোল বকছেন! ওকে, তার মানে তরুণ বাবুও বাইরে যাননি?
- না। এটাও পার্শিয়ালি সত্যি।
- আর ইউ ক্রেজি অর হোয়াট! এবার বলবেন খাঁড়াটাও বাইরে থেকে পাওয়া যায়নি!
- না, বাইরে থেকেই পাওয়া গ্যাছে আর এটাই একমাত্র হোল ট্রুথ, যে খাঁড়াটা বাইরে গেছিল।
স্যান্ডির ঠোঁঠে রহস্যের হাসি। তবে ডি এম এবার রাগে ফেটে পড়লেন।
- দেখুন স্যন্দিকা ম্যাডাম। বক্সার কেসটায় আপনি দারুণ করেছিলেন। কিন্তু এখন আপনি ওভার কনফিডেন্সে ভুগছেন। সি এম আপনার পরিচিত বলে আপনি যা ইচ্ছে, সিনাইল কথাবার্তা বলে যাবেন এটা হতে পারে না।
- মিঃ দত্ত কুল ডাউন। আগেরবারের মতন আরও খানিকটা বিশ্বাস রাখুন। প্লিজ। লেট মি এক্সপ্লেন।
গোটা ঘর নিঃশব্দ। সবাই বোধহয় নিশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছে। স্যান্ডি উঠে দাঁড়ায়। হাত দুটো একটু ঘষে নেয়। তারপরে যেন আনমনেই বলতে শুরু করে।
- গোপনো কথাটি রবে না গোপনে… রবি ঠাকুরের এই গানটা ভীষণ স্যুটেবল ফর দিজ সিচ্যুয়েশন। তরুণবাবু হার্ডকোর বিজনেসম্যান হলেও ওনার হবি ছিল হিস্টরি অ্যান্ড আর্কেওলজি।
স্যান্ডি কোণের টেবিলে রাখা একটা সাইড ব্যাগের দিকে এগিয়ে যায়। যেটা এতক্ষণ কেউ নজর করেনি। ব্যাগ থেকে গোটা কয়েক বই বের করে। হিস্ট্রি, আর্কেয়োলজি আর ভ্যালুয়েবল অ্যান্টিক্স-এর উপর।
- এগুলো সবই ওনার রুম থেকে পেয়েছি। আজ সকালে যখন স্থানীয় মানুষ নদী থেকে ওনার ভিজে যাওয়া কাটা মুন্ডু আর খাঁড়াটা নিয়ে এখানে দিয়ে যায় তারপরই আমি ওনার ঘর সার্চ করি। এ বাড়িতে বহু মুল্যবান অ্যান্টিক পিস ছিল।
স্যান্ডি তপনের দিকে তাকায়। তিনি অবাক চোখে স্যান্ডিকেই দেখছেন।
- আবার বলছি, ছিল। কারণ বেশ কিছুদিন হল আর নেই। তার আর্থিক মূল্য কয়েক লাখ টাকা হলেও অ্যান্টিক ভ্যাল্যু টাকা দিয়ে কেনার মতন নয়। এটা তরুণবাবু বুঝেছিলেন। ঠাঁঠবাটে তপনবাবু তার বাইরের জমক মেনটেইন করলেও প্রায় বছর দশেক ধরে তিনি খুব অনটনের মধ্যে ছিলেন। আই বিলিভ রাজনীতি ছাড়ার কারণ এবং আফ্টার এফেক্টই তার জন্য দায়ী। বছর আষ্টেক আগে আর সহ্য করতে না পেরে তিনি ভাইকে প্রস্তাব দেন ঐ সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার। সম্ভবত এটা প্রেডিক্ট করেই ওনাদের বাবা একটি বিচিত্র উইল করেন। এই সম্পত্তি বেচতে দুই ভাইয়ের সম্মতি লাগবে। কিন্তু ছোট ভাই আপত্তি করে। ফলত বিবাদ এবং বিচ্ছেদ।
স্যান্ডি একটু চুপ করে। টেবিল থেকে জলের বোতল তুলে জল খায়। সকলের চোখ ওর দিকে।
- কাল সুব্রতবাবু হঠাত্ বলে ফেলেন চক্রবর্তিকে তপনবাবু চিনতেন। ঠিকই বলেছিলেন। আসলে সুদখোর চক্রবর্তিকে শুধু চেনা নয় ধারও করেছিলেন উনি। নিজের ঠাঁঠ বজায় রাখতে। সম্ভবত সুব্রতবাবুকে উল্টো বুঝিয়েছিলেন। দোষটা বোধহয় নিজের ভাইয়ের ঘাড়ে দিয়েছিলেন। তাই আপনি মেয়ের বিয়ে তরুণবাবুর ছেলের সঙ্গে দিতে রাজী ছিলেন না। রাইট?
- আপনি কী করে জানলেন?
- জানাটাই যে আমার কাজ সুব্রতবাবু। কাল রাতেই আমি আমাদের চ্যানেলের আলিপুরদুয়ার করেসপন্ডেন্টকে ফোন করে তপনবাবুর ব্যাপারে এবং চক্রবর্তির সঙ্গে তার রিলেশনস-এর ব্যাপারে ডিটেল খোঁজ নিতে বলি। আলিপুরদুয়ারের মতন ছোট শহরে সবাই প্রায় সবার হাঁড়ির খবর রাখে। ফলত খোঁজ পেতে খুব একটা ডিফিকাল্টিজ হয়নি। একটু আগে আপনাদের সামনেই তার ফোন আসে। অ্যাকচুয়ালি আই থিঙ্ক, চক্রবর্তির নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতেই তারই সাহয্য নিয়ে ভাইকে না জানিয়ে জিনিষটি বিক্রি করেন তপনবাবু। তার থেকে টাকাও যথেষ্ট পান। হয়তো মনে অনুশোচোনা আসে। তাই ভাইকে ডাকেন মিটমাট করতে। জানিনা ধার মিটিয়ে এক্সট্রা কিছু ছিল কিনা। যেটা সত্ভাবে ভাইকে দিতেও চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে চক্রবর্তি জেনে যায় তপনবাবুর মন পরিবর্তনের কথা। অর্থাত্ ধারের বাইরে যে বখরা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা ভ্যানিশ করতে থাকে। তখন তিনি ভাইকে জানিয়ে দেবেন বলে সম্ভবত ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করেন। নিরুপায় তপনবাবু ভাইয়ের কাছে হ্যান্ডস-ডাউন সারেন্ডার করেন। কিন্তু রেজাল্ট হয় উল্টো। প্রব্যাবলি তরুণবাবু আইনের দ্বারস্থ হওয়ার হুমকি দেন, হুইচ ওয়াজ নট অ্যাক্সেপ্টেবল বাই তপনবাবু। এতদিনের সম্মান এভাবে খোয়াতে কারই বা ভাল লাগে! তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান। ভাই এবং ব্ল্যাকমেলার।
- এনাফ ইজ এনাফ ম্যাডাম। আষাড়ে গল্প না শুনিয়ে আগে আমার প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা দিন। স্টিল নো সেন্স।
এস পি ইন্টারাপ্ট করেন।
- গল্প না উপন্যাস এখনই ক্লিয়ার হবে এসপি সাহেব। প্রথম প্রশ্নের ব্যাখ্যা অলরেডি দিয়েছি। সেটা বোঝেননি। বুঝবেন পরেরগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার পর।
স্যান্ডি হেসে এস পি-র দিকে তাকায়।
- ইয়োর সেকেন্ড কোয়েশ্চেন ওয়াজ ভিক্টিম কেন চ্যাঁচালো না? ইউ অল নো, তপনবাবু স্বীকার করেছেন তিনি নিজেই এখনও নিজের হাতে বলি দেন। সো হি ইজ এবল টু ডু সাম ট্রিকস উইথ খাঁড়া। হরিকাকা কাল আমাকে বলছিলেন যৌবনে হি ইউজড টু ডু লট অফ ট্রিকস। আমার ধারণা ভিক্টিমকে সেরকম কোনো ট্রিকস দেখানোর নামে বাগানে নিয়ে যান। খাঁড়ার ট্রিকস দেখান। যার প্রমাণ শার্পলি কাট গাছের ছোট ছোট ডাল। যখন ভিক্টিম ঝুঁকে যাচাই করছেন, তখন এক কোপে গলা কাটা কি এমন ব্যাপার ফর আ ম্যান হ্যাবিচুয়েটেড টু পার্ফর্ম সাচ ফিটস।
- শীতের রাতে বাগানে ভিকটিম হঠাত্ ট্রিক দেখতে যেতে রাজী হল কেন? যে কোনো সেন্সিবিল লোকের সন্দেহ হবে।
- রাইট, আর এখানেই চমত্কার বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন খুনি। এমন কিছু বলেছেন যে ভিক্টিম যেতে বাধ্য হয়। সেটা কী, আই কান্ট সে। মে বি মার্ডারার উইল টেল আস।
- কিন্তু চক্রবর্তি কী করে…
- বললাম তো আসেনি। কাল আসলে এত বেশি লোক এক কালার, এক মেক এর স্যুট পড়েছিল, তাই কারো মাথায় স্ট্রাইক করেনি। মুন্ডুটা চক্রবর্তির হলেও বডিটা তরুণবাবুর। অটোপ্সি উইল প্রুভ দ্যাট। কাল পার্টির শুরুতে যখন তপনবাবু ফিরলেন হাতে থলি, আই থট সাম সারপ্রাইজ ফর পার্টি। সারপ্রাইজ, বাট টেরিবল। ওই থলিতে চক্রবর্তির মুন্ডু ছিল। আই বিলিভ পোলিস খুঁজলে ওর বডিটাও পাবে কাছাকাছি। যদি না বন্য জন্তু জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়ে থাকে। তপনবাবু গাড়িতে লুকিয়ে খাঁড়াটা নিয়ে দুপুরেই বেরিয়ে যান। চক্রবর্তিকে মেরে খাঁড়াটা পাঁচিল টপকে বাগানে ফেলেন। তারপর থলেতে মুন্ডু নিয়ে বাড়ি ঢোকেন। এরপর একই ভাবে ভাইকে মার্ডার করে তার মুন্ডুটা পাঁচিলের পিছনে নদীর দিকে ছুঁড়ে দেন আর খাঁড়াটা রাস্তার দিকে। এরপর জাস্ট চক্রবর্তির মুন্ডুটা তরুণবাবুর বডির সঙ্গে রেখে দেন। সিম্পল।
- মাই গড!
- আপনি তরুণবাবুকে ঠিক কী বলেছিলে… একি! তপনবাবু কই?
সকলেই ঘুরে তাকান তপনবাবুর শূণ্য আসনের দিকে। হরিকাকা তরিঘড়ি বাড়ির ভিতরের দিকে ছোটেন। বাকিরাও তাঁকে অনুসরণ করেন। দোতলায় তপনবাবুর ঘরে পৌঁছে সবাই স্তব্ধ হয়ে যান। সিলিং থেকে তপনবাবুর নিথর দেহ ঝুলছে। টেবিলে চাপা দেওয়া স্যুসাইড নোট, এতক্ষণ ধরে ব্যাখ্যা করা স্যান্ডির থিয়োরির প্রমাণ।
(চেস্টারটনের লেখা ফাদার ব্রাউন-এর দ্য সিক্রেট গার্ডেন গল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত)