বিতর্কিত বিষয়ের একটি পৃথক আবেদন রয়েছে বরাবর | একদিকে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে অর্থপূর্ণ তর্ক বিশেষ বিষয়টির প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে কিছু অপ্রকাশিত তথ্য উন্মোচিত করে, অপরদিকে বিতর্কিত বিষয় বিভিন্ন কর্মকান্ডের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে অনেক ক্ষেত্রেই | আর তৃতীয় পক্ষের ( এক্ষেত্রে পাঠকের ) যথেচ্ছ মস্তিষ্ক চালনার একটি মস্তবড় সুবিধা হলো তাকে কোনোদিনই তার ভাবনা চিন্তার মাশুল দিতে হয়না | আর তৃতীয় ব্যক্তি বরাবরই "হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা / নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা ।" -কেই মূলমন্ত্র ঠাওরে চলে এসেছে | তার উপর যদি তা কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্ত্ব হয় তাহলে তো ভাবনার সাথে সাথে "ছুট্লে কথা থামায় কে?/আজকে ঠেকায় আমায় কে ?" তাই আমিও বেশ খানিক পড়াশোনা ও পুঁথিপত্র ছানবিন করে "আজকে দাদা যাবার আগে / বল্ব যা মোর চিত্তে লাগে" | তাহলে পিছিয়ে যাওয়া যাক এক শতাব্দী ও তারও কয়েকদশক আগে | ১৮৬৯ সাল , ২রা অক্টোবর | জন্ম নিলেন জাতির জনক ও তারই সাথে বিস্তর বিতর্কের জনক | তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন তর্কের মধ্যে নিঃসন্দেহে প্রধানতমটি হলো তার "ব্রহ্মচর্য" অনুশীলনটি | আর এই বিষয়কে কেন্দ্র করে পিছু হাঁটলে তাঁর আত্মজীবনী থেকেই জানা যায় ১৮৮৫ সালে মৃত্যুপথযাত্রী পিতার নিশ্চিত মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে উনি বাধ্য হয়েছিলেন আদিম প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীগামিনী হওয়ায় এবং পিতার অন্তিম মুহূর্তে নিজের এই অনুপস্থিতিই তার "কামার্ত প্রেমবোধ"কে অতিক্রান্ত করতে তাড়না করেছিল | হয়তো উনি প্রেম, প্রকৃতি ও শক্তির যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন ব্রহ্মচর্যের মাধ্যমে |
ব্রহ্মচর্য কথাটি 'ব্রহ্ম' ও 'চর্য' দুটি পৃথক শব্দের একীকরণ | 'ব্রহ্ম' শব্দটি হিন্দু দর্শনে যা 'সনাতন অস্ত্বিত্ব'কে বোঝায় তা সংস্কৃত "বৃহঃ" ধাতু উত্তর "মন" প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে | "বৃহঃ" শব্দের অর্থ বিস্তার ও "মন" প্রত্যয়ের অর্থ অতিশয় | অপরদিকে 'চর্য' শব্দের অর্থ যাপন করা বা কোনো এক সুনির্দিষ্ট জীবনযাত্রাকে অনুসরণ করা | সুতরাং দুইয়ে মিলিত হয়ে যে অর্থ করা যায় তা হলো "জগৎব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে যে সত্ত্বা" তাকে অনুসরণ করে যে জীবনযাপন তাই-ই ব্রহ্মচর্য | ইতিহাস ঘাঁটলে এই ব্রহ্মচর্যের কঠোর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় বৈদিক যুগে | যে কোনো বিশেষ অনুশীলন তা সে ধর্মীয় অনুশীলনই হোক বা নিছক লোকাচারই হোক, তা নির্দিষ্ট কালগন্ডি অতিক্রম করলে সমালোচিত হয়ে থাকে এবং এটিই পরিবর্তনশীলতা ও তৎকালীন অবস্থা থেকে প্রগতিশীলতার এক অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ | এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি |
৩৮ বছর বয়সে ব্রহ্মচারী হলেন এবং অবশ্যই তা এই উপমহাদেশের বুকে কোনো নতুন ঘটনা নয় | এমনকি 'বীর্য সংরক্ষন' এর উপর বিশেষ গুরত্ত্ব আরোপও বিতর্কের সৃষ্টি করেনি | কিন্তু এই বিশেষ জীবনযাপন সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ একটি বিশেষ মাত্রা পায় সমালোচক তথা আপামর সাধারণ মানুষের কাছে | হ্যাঁ , সংক্ষেপে 'বিশেষ মাত্রা' বলাই বুদ্ধিমানের কাজ কারণ ক্ষেত্র ও সময় বিশেষে এটি বিতর্ক, জনরোষ বা সমালোচনার ঝড় তুলেছে | এমনকি ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে - নিউ দিল্লিতে দ্য ন্যাশেনাল আর্কাইভস নামক পত্রিকায় গান্ধীজি ও হারমান কালেনবাখ নামক তাঁর এক সাউথ আফ্রিকান এক নিকট বান্ধব যিনি পেশায় একজন জার্মান আর্কিটেকট ছিলেন, তাঁর সাথে বিনিময় হওয়া কিছু অপ্রকাশিত চিঠি তাঁর সমকামিতার দিকে আলোকপাত করে তার যৌন অভিযোজন অর্থাৎ "sexual orientation" সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দেয় | গান্ধীজির যৌনজীবন সম্পর্কে নেহেরু যথেষ্ট স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন, "অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃত" | লেট্ ভিক্টরিয়ান যুগের অতিনৈতিকতা তাঁর জীবন যাপনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর ৩০ বছর পরবর্তী জীবনে |
তাঁর প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে বয়স নির্বিশেষে নগ্ন নারীদের সাথে রাত্রি যাপন ও ধৌতি তাঁর ব্রহ্মচর্য পালনের প্রধান পন্থা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল | প্রশ্নের সম্মুখীন হলে উনি জানান যে এটিই তাঁর আত্মসংযম পরীক্ষা করার শ্রেষ্ঠ উপায় | এই বিষয়ে পরবর্তীকালে আশ্রমে বসবাসকারী মহিলাদের মধ্যে যথেষ্ট রোষের সৃষ্টি হয়েছিল বলে জানা যায় | মনুবেন ও আভাবেন যাঁরা ওনারই নিকটাত্মীয়া তরুণী, তাঁদের সাথে নিয়মিত নগ্ন অবস্থায় রাত্রিযাপন ও ধৌতি যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দেয় ঠিকই কিন্তু এই মনুবেন এর দিনলিপিতেই তাঁকে মনুবেন "Bapu, my mother" অর্থাৎ তাঁর জন্মদাত্রী হিসেবে উল্ল্যেখ করা হয়েছে | এই মাতৃত্ব যে শারীরবৃত্তীয় নয়, এ নিছকই স্রষ্টা অর্থে ব্যবহৃত তা যথেষ্টই অনুধাবনযোগ্য | অর্থাৎ এসবের পরেও কিছু বিষয় রয়ে যায় যা ওনার ভাবমূর্তিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে উঠতে পারেনি | আর ঠিক এই কারণেই তাঁর মৃত্যুর ৭০ বছর পরেও তাঁকে নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেও কোথাও যেন তাঁর শীর্ণ শরীরের শিলারূপটিকে আহত করতে পারেনা | আমরা ভুলে যেতে পারিনা যে যাবতীয় বিতর্কের মধ্যেও, যার অধিকাংশটিই তাঁর নিজের দ্বারা জনসমক্ষে প্রকাশিত, ওনার পদযাত্রায় পা মিলিয়েছেন হাজার হাজার নারী এমনকি তার দর্শনে আকৃষ্ট নারীর সংখ্যাও নেহাত কম না অথচ ব্রহ্মচর্যার নামে "নারী শোষণ"এর শিরোপাও তাঁকে ব্যাঙ্গার্থে অলংকৃত করেছে |
তাঁর ব্রহ্মচর্য বহুক্ষেত্রেই প্রবল যৌনাসক্তি ও যৌনবিকৃতির তকমা পেলেও আমরা অবহিত নই যে এই বীর্য সংরক্ষণের মাধ্যমে মূলাধার চক্রে নিহিত কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করার প্রথা যথেষ্টই প্রচলিত এবং এর উপর ভিত্তি করে বহু প্রাচীন কাল থেকে গ্রাম বাংলায় বাউল নামক একটি জনজাতি আজ বর্তমান | এই বাউল জনজাতিও তাদের তথাকথিত "উশৃঙ্খল জীবনযাত্রার" জন্য বহুল সমালোচিত | তাঁরা মহিলাদের শরীর নিঃসৃত ঋতুচক্রকালীন রক্ত ও পুরুষের যৌনাঙ্গ নিঃসৃত বীর্য সংরক্ষন করে অন্তঃস্থিত আত্মিক মহাশক্তি কে জাগরণের উদ্যেশ্যে বিভিন্ন সামাজিক নিষেধজ্ঞাকে অতিক্রম করে সাধারণ জনগণের চোখে "অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃত" জীবনযাত্রায় সামিল | মানব - মানবীর শারীরবৃত্তীয় চাহিদাকে 'প্রেম' এর রঙিন মোড়ক থেকে মুক্ত করে আধ্যাত্মিকতার স্তরে উত্তীর্ণ করে ব্রহ্ম অর্থাৎ সর্বব্যাপী সত্ত্বার সাথে আত্মিক সংযোগ স্থাপন করার জন্যই এই মতাদর্শের অবতারনা |
সে যাই হোক, যা কিছু প্রকৃতি বিরুদ্ধ, বা বলা ভালো যা কিছুই সংখ্যা গরিষ্ঠ দ্বারা স্বীকৃতি পায়নি , সেসব কিছুই আপামর জনসাধারণের কাছে তীব্র সমালোচনা যোগ্য | আরো নির্দিষ্টভাবে বলা ভালো তীব্র "নিন্দনীয়"|
আমরা, যারা সাধারণ মানুষ, তারা নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় এতখানি ব্যাপৃত থাকি যে, যা কিছু প্রথা বিরুদ্ধ বা যা কিছুই গড্ডলে সামিল হয়না, তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করে থাকি অতি সহজে | অনিশ্চয়তার দোলাচল বা পরখ করে বিচার করার ঝুঁকি নেওয়া আমাদের খুব একটা পছন্দ নয় কোনোকালেই | তার পরিবর্তে কোনো একটি পক্ষকে সরাসরি সমর্থন করাই আমাদের পক্ষে সুবিধাজনক | তাই বরাবরই আমরা - হয় পক্ষে নয় বিপক্ষে | হয় নিন্দায় নয় প্রশংসায় | হয় ভালোয় নয় মন্দয় | এর কোনো একটি আমাদের আঁকড়ে নিতেই হবে, এইই যেন আমাদের প্রতিজ্ঞা | অথচ সাদা ও কালোর মাঝে যে একটি ধূসর বলে বর্ণ আছে, দিবস ও রাত্রির মাঝে যে একটি গোধূলি বলে লগ্ন আছে, তা স্বীকার করতে আমাদের বড় অনাগ্রহ | বিশ্ব জুড়ে একটিই রব সুস্পষ্ট ও জোরালো - "হয় আমার মতো নয়তো অসামাজিক বা উশৃঙ্খল বা ছন্নছাড়া" | তাই যতই বলা হোক, বিচার পাঠকের হাতে রইলো, পক্ষ সমর্থনকারী আরো খানিক সমর্থন করে ফেলবে আর বিপক্ষ সমর্থনকারী আরো খানিক উচ্চগ্রামে বিপক্ষে কথা বলে নেবে | তা যদি না হতো, তবে "যত মত তত পথ" বাণী হয়ে পাঠ্য বইএর পাতায় বন্দি না থেকে থেকে মূলমন্ত্র হয়ে জীবনকে সমৃদ্ধ করে তুলতো অনায়াসে |